কেউ বললেন সাফল্যের গল্প। কেউ শোনালেন স্বপ্নের কথা। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারীরা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলার দুর্দমনীয় সংকল্পের কথা তুলে ধরলেন অতিথিদের সামনে। অনুপ্রাণিত করলেন তাঁদের। অতিথিরাও বিপুল করতালিতে অভিনন্দিত করলেন কৃতীদের।
শনিবার সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের সংবর্ধনা ও তাঁদের দৃপ্তপ্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পের ভেতর দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন করল প্রথম আলো।
বরাবরের মতোই ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রথম আলো নারীদের নিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ধানমন্ডির ছায়ানট সাংস্কৃতিক ভবন মিলনায়তনে। এতে সহায়তা দিয়েছে সিটি ব্যাংকের নারী ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রম ‘সিটি আলো’। অনুষ্ঠানে প্রথম আলো ও সিটি ব্যাংকের নারী কর্মীরা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য নারী ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, চিকিৎসক, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। মিলনায়তনের ধারণ ক্ষমতার অধিক ছিল উপস্থিতি। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘সমতা ক্ষমতায়ন অধিকার, কন্যা নারী সবার।’
বেলা সাড়ে তিনটায় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আজ আমরা যখন এখানে নারী দিবসের অনুষ্ঠান করছি, তখন হয়তো দেশের কোথাও কোনো কন্যা রাজপথে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। কোনো নারী গণপরিবহনে নিগৃহীত হচ্ছেন বা সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এ মুহূর্তে মাগুরায় পাশবিকতার শিকার সেই শিশু হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে নারীদের জন্য একটি নিরাপদ সমাজ নির্মাণের প্রত্যাশাকেই তুলে ধরতে চাই।’
অনুষ্ঠানে ছিল কয়েকটি পর্যায়। প্রথমে সফল নারীদের সংবর্ধনা। পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান মানাস ও রেস্তোরাঁ সঞ্চয়িতার উদ্যোক্তা ফায়জা আহমেদ মঞ্চে এসে বলেন, চারুকলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে। তাঁর স্বপ্ন ছিল স্বাধীনভাবে কাজ করা। একটা সময় তিনি ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে কাজ শুরু করেন। পরে যুক্ত করেছেন রেস্তোরাঁ। কঠিন পথ অতিক্রম করে সফল হয়েছেন।
ডা. মাহমুদা মিতু সফল হয়েছেন অনলাইনে একটি গ্রুপ করে প্রসূতি নারীদের সেবাদান করে। তিনি বলেন, একটা সময় তিনি দেখতে পান, অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা–সংক্রান্ত যেসব পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তা সঠিক নয়; বরং খুবই বিপজ্জনক। তখন তিনি যথাযথ চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়ার জন্য একটি গ্রুপ তৈরি করে সেবাদান কার্যক্রম শুরু করেন।
মাহমুদা মিতু বলেন, গণ-অভ্যুত্থানকালে তাঁর সহকারীর ছেলে গুলিতে মারা যায়। প্রতিদিনই বহু মানুষ মারা যাচ্ছিলেন। সেই সময় তিনি আর ঘরে বসে থাকতে পারেননি। সরাসরি রাজপথে নেমে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠকের দায়িত্বে রয়েছেন। অভ্যুত্থানের চেতনায় তিনি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে অবদান রাখতে চান, নিশ্চিত করতে চান নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা।
সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি কৃতী দুজনকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান। তিনি প্রথম আলোর এ আয়োজনের প্রশংসা করে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় যে বৈষম্যহীন নিরাপদ সমাজ গঠনের আশার সঞ্চার হয়েছিল, ইদানীং নারীদের ওপর হামলা ও নির্যাতন–নিগ্রহের ঘটনাগুলোর কারণে সেই আশা মলিন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও অভিনয়শিল্পী কারিনা কায়সার। কৃতী দাবাড়ু রানী হামিদের নাতনি ও ফুটবলার কায়সার হামিদের কন্যা তিনি, মা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কারিনা বলেন, বাড়িতে এত কৃতী মানুষের মধ্য থেকে তিনি স্বতন্ত্র পরিচয়ে বড় হতে চেষ্টা করেছেন। পরিবারের সবাই তাঁকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানান প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক।
আরও তিন কৃতী নারী ফুটবলার—ঋতুপর্ণা চাকমা, কৃষি ব্লগার উম্মে কুলসুম পপি ও বন অধিদপ্তরের ফরেস্টার মিতা তঞ্চঙ্গ্যার সাফল্যের কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়। গতকাল প্রথম আলোর নারী দিবসের ক্রোড়পত্রেও তাঁদের সাফল্যের কথা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা ঢাকার বাইরে অবস্থান করায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
‘দৌড়, সাঁতার ও সাইকেল চালনা’—এই তিন বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘আয়রনম্যান’ প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশে প্রথম নারী হিসেবে ‘আয়রনম্যান’ প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব অর্জন করে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেছেন ক্রীড়াবিদ ফেরদৌসী আক্তার মারিয়া। মঞ্চে এসে মারিয়া তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, অনেক পরিশ্রম করে এ যোগ্যতা অর্জন করেছেন তিনি; কিন্তু তাঁর নিজের কোনো সাইকেল নেই। এ ধরনের সাইকেল বেশ দামি। কেনার সামর্থ্য নেই। তাঁর বক্তব্য শেষ হতেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন পেশাজীবী নারী নিজেদের উদ্যোগে মারিয়াকে এমন একটি সাইকেল কিনে দেবেন বলে জানান।
পরে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, মারিয়াকে আগামী নভেম্বরে স্পেনে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পর্বে অংশ নেওয়ার জন্য সব রকম সহায়তা দিয়ে পাশে থাকবে প্রথম আলো।
এরপর মঞ্চে আসেন দেশের প্রথম নারী স্কুবাডাইভার জান্নাতি হোসেন। তিনি জানান, নারী হয়ে তাঁর পক্ষে স্কুবাডাইভিং শেখা খুব কঠিন আর ব্যয়বহুল ছিল। যখন সাগরে নামেন, তখন তাঁর মনে হয় যেন অনন্ত অসীমের মধে৵ ভেসে চলেছেন। এখন তাঁর স্বপ্ন, দেশে একটি স্কুবাডাইভিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
এই দুই কৃতী নারীর হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দিয়ে অভিনন্দন জানান গিনেস বুক রেকর্ড অধিকারী ক্রীড়াবিদ জোবেরা রহমান লিনু। এবার একুশে বইমেলায় প্রথমা প্রকাশন থেকে জীবনজালের এপার-ওপার নামে তাঁর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রাণীর প্রতি মমতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন ডা. রাফিয়া আলম। মঞ্চে এসে তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তির পর থেকেই ক্যাম্পাসের আশপাশের কুকুর-বিড়ালের প্রতি তাঁর সহানুভূতি জাগতে থাকে। নিয়মিত খাবার দিতেন। করোনার সময় প্রাণীগুলো খাবারের অভাবে খুবই কাতর হয়ে পড়লে তিনি বিশেষ পরিচর্যা করতেন। তাঁকে অভিনন্দন জানান স্টেট ইউনিভার্সিটির সহ–উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নওজিয়া ইয়াসমিন।
শেষে ছিল প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা শেষে পেশাগত জীবন শুরু করা অদম্য মেধাবী ও অদ্বিতীয়া বৃত্তি নিয়ে দুই কৃতী নারীর সংবর্ধনা। অদম্য মেধাবী ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক খায়রুম ইসলাম মঞ্চে এসে জানান, খুব অল্প বয়সে তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। নিজে টিউশনি করে পড়ে এসএসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছিলেন। তারপর প্রথম আলো ট্রাস্টের শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে অধ্যয়ন চালিয়ে গেছেন। এখন তিনি শিক্ষকতা করছেন। ইচ্ছা আছে পিএইচডি করার। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান তিনি।
অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া তানিয়া আক্তার এখন এক্সিম ব্যাংকের কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে একজন উদ্যোক্তা হওয়া ইচ্ছা তাঁর।
এই দুই কৃতীকে অভিনন্দন জানান সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান। তিনি বলেন, ‘ইদানীং নারীদের ওপর যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, তাতে মনে হয় যেন সমাজে চারপাশ থেকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তবে আশা করি, এই নারীরা তাঁদের আত্মশক্তির মধ্য দিয়ে আঁধার কাটিয়ে আলোর পথে এগিয়ে যাবেন।’
অনুষ্ঠানে সিটি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ অপারেটিং অফিসার মাহিয়া জুনেদ বলেন, প্রথম আলোর এই আয়োজনের সঙ্গে তাঁরা অংশ নিতে পেরে আনন্দিত। সিটি ব্যাংক তাদের সিটি আলো নামের বিশেষ সেবার মাধ্যমে নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে ভূমিকা রাখছে। কর্মক্ষেত্রে ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে যাওয়া নারীদের পুনরায় কাজে যোগদানের সুযোগ তৈরি করার একটি বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে সিটি ব্যাংকের।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, প্রথম আলো নিয়মিতভাবে নারী দিবসের এ অনুষ্ঠান করছে। প্রথম আলোর লক্ষ্য সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে তাঁদের অগ্রযাত্রায় সহায়তা করা। বাংলাদেশের সাফল্য, দেশের মানুষের সাফল্যে ভূমিকা রাখা, অনুপ্রাণিত করা।