মেয়েটির একটি হাত কেটে ফেলতে হতে পারে

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

মুখের কিছু অংশ আর দুই পায়ের পাতা ছাড়া মেয়েটির পুরো শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। তার ডান হাতটি যাতে কেটে ফেলতে না হয়, সে জন্য আজ রোববার জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশেষ অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় মেয়েটি ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেও তার মুখে যন্ত্রণার ছাপ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে মেয়ের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে মা বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় জানালেন, মাদ্রাসায় পড়া ১৬ বা ১৭ বছর বয়সী মেয়ে শুক্রবার দুপুরে বাড়িতে একা ছিল। হামলাকারী কোনোভাবে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। মেয়ের গলা চিপ দিয়ে ধরেন। মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে মরে গেছে ভেবে আসামি আশপাশে থাকা চটের বস্তা, কাপড় দিয়ে তার শরীর ঢেকে আগুন ধরিয়ে দেন। দাউ দাউ করা আগুনের আঁচে মেয়ের জ্ঞান ফিরলে দৌড়ে পাশের বাড়িতে এক আত্মীয়ের কাছে গিয়ে আসামির নাম উল্লেখ করে ঘটনার কথা জানায়।

তারপর এলাকাবাসী একই এলাকার বাসিন্দা ওই হামলাকারীকে ধরে মারধর করে পুলিশে খবর দেন। এলাকাবাসী মেয়েকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। মেয়ের বাবা বাদী হয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ থানায় ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে (সংশোধনী ২০০৩) ধর্ষণসহ শরীরে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা ও সহায়তা করার অপরাধে মামলা করেন। অন্যদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মেয়েকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। শনিবার রাত ১২টার পর মেয়েকে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আজ দুপুরে হাসপাতালে মেয়ের মায়ের সঙ্গে কথা হয়। মা জানালেন, ঘটনার সময় তিনি, তাঁর স্বামী ও আরেক মেয়ে বাড়িতে ছিলেন না। মেয়ের খবর পেয়ে যেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে দেড়-দুই ঘণ্টা লাগে। ততক্ষণে এলাকাবাসী মেয়েকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে কিছু বলেনি। ঘটনার পর থেকে মেয়ে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছে। তাই মা নিজেও মেয়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাননি। তবে গলায় এত জোরে আসামি চাপ দিয়ে ধরেছিলেন যে মেয়ে কোনো কিছু খেতে পারছে না। মেয়ের শরীর পোড়েনি, ///////////এতটুকু জায়গা খুঁজে পেতেও কষ্ট করতে হবে।

চোখের সামনে মেয়েকে কষ্ট পেতে দেখে এই মা বললেন, তাঁর মেয়েকে যে এমন কষ্ট দিয়েছেন, তাঁর ফাঁসি চান তিনি। কোনোভাবেই আপস করবেন না।

এই মা জানালেন, তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা বলতে গেলে দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। বগুড়া থেকে অ্যাম্বুলেন্সে মেয়েকে আনতে কতগুলো টাকা চলে গেছে। মেয়ের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা কেমনে সামাল দেবেন, সে চিন্তাও গ্রাস করেছে এই মাকে।

শুক্রবার দুপুরের সেই মুষলধারে বৃষ্টি হয়তো মেয়েকে বাঁচিয়ে দিতে সহায়তা করেছে বলে মনে করছেন এই মা। তিনি জানালেন, আগুনের আঁচে জ্ঞান ফিরলে মেয়ে দৌড়ে পাশের বাড়িতে যায়। তখন বৃষ্টিতে আগুন অনেকটাই নিভে আসে। তবে এর মধ্যেই যেটুকু পোড়ার তা পুড়ে গেছে। এই মা জানালেন, আসামিপক্ষ প্রভাবশালী বা তাদের সঙ্গে শত্রুতা ছিল, এমন না। আসামি বিবাহিত।

হাসপাতালে মেয়ের বাবা ও চাচা প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন না। ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, এগুলো লিখে কী করবেন? যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। সামাজিকতা, মেয়ের বিয়ে এগুলো নিয়ে চিন্তাও ঘিরে ধরেছে তাঁদের।

মামলাটি তদন্ত করছেন বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জিল্লুর রহমান। তিনি আজ মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ধর্ষণ করার পর মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। মেয়েটি মারা গেছে ভেবে আসামি মেয়েটির শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়।’

মামলার মূল আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন জানিয়ে ওসি জিল্লুর রহমান বলেন, অপর দুই অভিযুক্তকে এখনো ধরা সম্ভব হয়নি। মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছে কি না, সে-সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

মেয়েটির ডান হাতটি কেটে ফেলতে হতে পারে
আজ দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির শরীরের ২৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। মুখের কাছে পোড়া থাকায় শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। মেয়েটি শঙ্কামুক্ত, তা বলার উপায় নেই। তার ডান হাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বুক, পিঠ, স্তন, পা–সহ শরীরের যেসব জায়গা পুড়েছে, সব জায়গাতেই গভীর ক্ষত হয়েছে।

মেয়েটির ডান হাতের অবস্থা প্রসঙ্গে চিকিৎসক মো. আশিকুর রহমান বললেন, ‘ডান হাতের ক্ষত খুব বেশি। আজ জরুরি ভিত্তিতে একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। অন্তত হাতটি যাতে কেটে ফেলতে না হয়, সে জন্য এ অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তবে হাতটি রক্ষা পাবে কি না, তা এখনই বলা সম্ভব না।’

মো. আশিকুর রহমান জানালেন, মেয়েটিকে দুই থেকে আড়াই মাস হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। অনেকগুলো অস্ত্রোপচার করা লাগবে। সরকারি হাসপাতালে ওষুধসহ বিভিন্ন সহায়তা দেওয়ার পরও মেয়েটির সঙ্গে বাবা বা মা বা অন্য কাউকে থাকতে হবে। অন্যান্য খরচ আছে। সব মিলে খরচটাও একেবারে কম হবে না।

মেয়েটিকে প্রথমে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। তবে সে ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকতে পারে, এ জন্য তাকে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। কেননা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

চিকিৎসক আশিকুর রহমান জানালেন, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারকে চিঠি লিখে বিষয়টি জানানো হয়েছে। প্রয়োজন হলে হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগ থেকেও সহায়তা পাওয়া যাবে। মেয়েটির শারীরিক পরিস্থিতি নজরদারি এবং মানুষজন থেকে একটু দূরে রাখার জন্য হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করার বিষয়টিও বার্ন ইউনিট কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় রেখেছে।

হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েটির চিকিৎসায় কেউ যদি আর্থিকভাবে সহায়তা করতে চান, তা নেবেন কি না, জানতে চাইলে মেয়েটির মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কেউ আর্থিক সহায়তা দিলে তিনি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন। এই মা তাঁর মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন। মেয়েটা অন্তত বেঁচে থাকুক। আবারও মনে করিয়ে দিলেন, তিনি আসামির ফাঁসি চান।