জানতাম না, কী এক ভয়াবহ ইন্ট্রো অপেক্ষা করছে

২০০৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হত্যাচেষ্টার মামলা নিয়ে গড়িমসি চলে। তৎকালীন সরকার নানা উপায়ে তদন্তও বিপথে নেয়। প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বছর ধরে প্রথম আলো অনবরত অনুসন্ধান করে চলেছে সমসাময়িক ইতিহাসের চাপা দেওয়া ঘটনার পেছনের সত্য। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তার অন্যতম। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে সে অনুসন্ধানের কিছু নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য পেশ করা হলো।

গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
ছবি: জিয়া ইসলাম

আমি মঞ্চের ১০-১৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে শেখ হাসিনার বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে রমনা ভবনের পেট্রল পাম্পের গলিমুখে চলে যাই। শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানের খবর সংগ্রহের কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম, তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে। তাই একটা ভালো ইন্ট্রোর (সংবাদ সূচনা) আশায় অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে মঞ্চের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। তখনো জানতাম না আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ ইন্ট্রো।

শেখ হাসিনা যথারীতি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে ২০-২২ মিনিটের বক্তৃতাটি শেষ করলেন। আমার চোখে এখনো ভাসছে, তাঁর হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে মঞ্চ থেকে নামার জন্য কেবল একটি পা বাড়িয়েছেন, তখনই একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার কয়েক গজের মধ্যেই শব্দটি হলো অনুমান করলাম।

শব্দটা আমার কাছে অপরিচিত লাগল। ট্রাকের চাকা ফেটে গেলে যেমন শব্দ হয়, অনেকটা তেমন। এ রকম কোনো শব্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্র সংঘর্ষের সময় বা সাংবাদিকতা করতে এসে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও শুনিনি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পরপর আরও দুটি শব্দ শুনলাম। তারপরও আমি আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি। অনেকটা হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি। মুহূর্তেই চোখে পড়ল ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের স্রোত আমার দিকে ধেয়ে আসছে। হয়তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কারণে আমিও ছুটতে শুরু করলাম। আজ মনে হয়, সেদিন যদি দৌড় না দিতাম, তাহলে পদপিষ্ট হয়েই হয়তো মারা যেতে হতো।
হঠাৎ আমার সংবিৎ ফিরে এল। আমি সাংবাদিক। অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে তার সংবাদমূল্য অনেক।

আমি দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আমি দৌড়ে রমনা ভবনের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠি। আমার ধারণা হলো, আমিও নিরাপদ থাকব, ঘটনাও দেখতে পারব। আমি যখন সিঁড়িতে, তখনো কয়েক সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসছিল। দোতলায় গিয়ে দেখি, ভয়ার্ত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে মূল রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

সেখানে আরও কয়েকজন সাংবাদিককে পেলাম। এখানে ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব ও পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ। ভয় আর আতঙ্কমিশ্রিত চোখে একে অন্যের দিকে তাকাই। আমি প্রচণ্ড ভয় পাওয়ায় আজাদ ভাই আমার কোথাও লেগেছে কি না, নিজেই দেখলেন। এ সময় কেউ একজন বললেন, মাথা নিচু করে দেখো।

হামাগুড়ি দিয়ে শেখ হাসিনার অবস্থা দেখতে চেষ্টা করলাম। লক্ষ্য করলাম, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, মানুষের আহাজারি, আর্তনাদ আর প্রাণভয়ে ছোটাছুটিতে একটু আগের প্রাণবন্ত সমাবেশের চেহারা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ধোঁয়ার মধ্যে শেখ হাসিনাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটি দেখলাম। আর ট্রাকের ওপর শেখ হাসিনাকে মানববর্ম হয়ে ঘিরে রেখেছেন কয়েকজন নেতা ও দেহরক্ষী। এর মধ্যে আরও কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ পেলাম।

সঙ্গে গুলির শব্দও। একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দে প্রাণভয়ে আমরা একবার রমনা ভবনের তিনতলায় যাই, আরেকবার দোতলায় ফিরে আসি। এভাবে যে কতবার দোতলা-তিনতলা ওঠানামা করেছি, তা আর আজ মনে নেই। ফাঁকে ফাঁকে শেখ হাসিনার অবস্থা দেখতে বারান্দার খোলা জায়গায়ও এসেছি। প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে কোনো কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। একপর্যায়ে দ্রুতবেগে শেখ হাসিনার গাড়িটি চলে যেতে দেখলাম।
এ সময় এক সাংবাদিককে দেখলাম মোবাইল ফোনে কাকে যেন চিত্কার করে বলছেন, ‘...ভাই, কেয়ামত হয়ে গেছে।’ আমারও অফিসে ফোন করার কথা মনে পড়ল।

মোবাইল ফোনে আমাদের তখনকার প্রধান প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। তাঁকে না পেয়ে বার্তা সম্পাদককে চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে সম্পাদককে প্রাণান্ত চেষ্টা করি। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছি। প্রচণ্ড উত্তেজনা আর ভয়ে ঠিকমতো মোবাইলের বোতাম চাপতে পারছিলাম কি না সন্দেহ। যা হোক, একপর্যায়ে প্রধান প্রতিবেদককে পেয়ে যাই। কিন্তু তাঁকে কী বলেছিলাম আজ মনে নেই। বোধ করি আমার গলা ফাটানো চিত্কার শুনে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে, এ রকম কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি।

এদিকে ১২-১৩ বার বিস্ফোরণের শব্দের পর হঠাৎ করেই পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ শুরু করে। রমনা ভবনের দোতলার যেদিকটায় আমরা ছিলাম, সেখানেও কয়েকটা শেল এসে পড়ল। ধোঁয়ায় গোটা এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গ্যাসের ঝাঁজে চোখ জ্বলছে। রমনা ভবনের দক্ষিণ প্রান্তের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। কয়েকজন সহকর্মীর নিষেধ এড়িয়ে জিরো পয়েন্ট আর গোলাপ শাহ মাজার বরাবর রাস্তার মাঝখানে গেলাম।

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আরও সামনে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর পশ্চিম প্রান্তে গিয়ে যা দেখলাম, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

রক্তাক্ত রাজপথ। ছিন্নভিন্ন দেহ। চারদিক থেকে ভেসে আসছে গোঙানির শব্দ। ট্রাকের বাঁ পাশে আওয়ামী লীগের নেত্রী আইভি রহমান পড়ে আছেন। তাঁর নিথর দেহ দেখে মনে হলো, তিনি মারা গেছেন। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছেন আরও কয়েকজন নারী। তাঁরা আহত না নিহত, বোঝার উপায় ছিল না। ট্রাকের ডান পাশে ক্ষতবিক্ষত মানুষের সারি। তাঁদের কেউ কেউ সাহায্যের জন্য অতি কষ্টে রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ চিত্কার করে কিছু বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। রাস্তায় পড়ে আছে শত শত স্যান্ডেল।

ততক্ষণে অনেকেই উদ্ধারকাজে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা আহত অনেককে ধরাধরি করে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে নিয়ে যান। একপর্যায়ে পুলিশ ও সাংবাদিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কেউ একজন এসে বললেন, অদূরে অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেড পড়ে আছে। গিয়ে দেখি, যেখানটায় আমি প্রথম দাঁড়িয়ে ছিলাম, পেট্রল পাম্পের সেই গলির মুখেই গ্রেনেডটি পড়ে আছে।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষুব্ধ কিছু কর্মী ভাঙচুর শুরু করেন। প্রচণ্ড ভয় পেলেও ঘটনাস্থল ত্যাগ করিনি। এদিক-ওদিক ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। মোবাইলে ফোন করে অনেকেই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। কাউকেই কিছু বলতে পারছিলাম না। মনে পড়ে, সেই ভয়াল পরিবেশে আমার আম্মার ফোন পেয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। অফিসের আরও কয়েকজন সহকর্মী ঘটনাস্থলে এলে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা কি পৌনে সাতটার দিকে আমি অফিসের উদ্দেশে রওনা হই।

দীর্ঘ ১৯ বছরের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও এ ঘটনার আগে বা পরে কখনো এ রকম সভা-সমাবেশে হামলা বা বড় ধরনের সংঘর্ষে ঘটনা দেখতে হয়নি। মাংস কাটার দৃশ্য দেখতে হবে বলে এখনো কোরবানিস্থলের ধারেকাছে যাই না। আর সেই আমি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ রকম একটি ভয়াবহ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে গেলাম!

স্বাভাবিকভাবেই এ ঘটনায় প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পাই। কতটুকু নোট নিয়েছিলাম জানি না, তবে অফিসে এসে প্রতিবেদন তৈরির সময় পুরো ঘটনাই আমার চোখের সামনে ভাসছিল। কিন্তু কম্পিউটারে বসে কি-বোর্ডে হাত রাখলেও ইন্ট্রো লেখার পর প্রতিবেদন আর এগোচ্ছিল না। তখন এক সহকর্মীকে ডেকে তাঁর কাছে ঘটনা বলতে থাকলাম, তিনি তা কম্পোজ করতে থাকলেন।

এ ভয়াবহ ঘটনার ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তা ভুলতে পারি না। বেঁচে থাকা পর্যন্ত কখনো তা ভোলা সম্ভব নয়। নিরীহ মানুষের ওপর এই নারকীয় হামলার কথা মনে হলেই গা শিউরে ওঠে। প্রার্থনা করি, আর যেন কাউকে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হতে হয়। কোনো ২১ আগস্টের দুঃসহ স্মৃতি যেন কাউকে আর তাড়া করে না ফিরে।

জাহাঙ্গীর আলম: প্রথম আলোর প্রতিবেদক হিসেবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

প্রথম আলো, ২১ আগস্ট ২০১৬