বইয়ের জগতে পাঠকের আশ্রয়

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লিটলম্যাগ চত্বরের সেগুনগাছটায় ঝোলানো কাগজে লেখা ‘জগৎতলা’। মেলা শুরুর পর কেউ ঝুলিয়েছেন সেটা। মানুষটি হয়তো বর্গফুটের মাপের হিসাবের বাইরে চত্বরটিকে আরও বেশি কিছু বোঝাতে চাইছেন। মেলায় আসা মানুষের আনন্দযজ্ঞের মাপ হয় না যেমন সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুটের হিসাবে।

প্রকাশকেরা বলেছেন, ছুটির চেয়ে অন্য দিনে বই বিক্রি ভালো হয়। অনেকে আবার মেলা থেকে শুধু তালিকা সংগ্রহ করে পরে অনলাইনে অর্ডার করেছেন। গতকাল শনিবার আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি বললেন, ‘এখন লেখক–সংকট চলছে। অনেক লেখকই তৈরি নন। এখনো হুমায়ুন আজাদের বই যত বিক্রি হয়, অন্যদের তা হয় না।’ একই কথা শোনা গেল অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়ন থেকেও।

হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তার কাছে এখনো যেতে পারছেন না নতুন লেখকেরা। এই সংকটের মধ্যে মেলার মাঠে শুরু হলো টিকিট ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা। মাওলা ব্রাদার্সের সামনের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে এ নিয়ে মত দিলেন কথাসাহিত্যিকেরা। মোরশেদ শফিউল হাসান বললেন, ‘সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকার সময় বইমেলায় প্রবেশের জন্য পাঁচ বা দশ টাকা প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করে টিকিটও ছাপানো হয়েছিল। পরে নানা রকম চাপে তা বাতিল হয়।’ তাঁর কথায় সম্মতি জানিয়ে কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈনউদ্দীন জানালেন, মেলায় টিকিট ব্যবস্থা হলেও এত মানুষই আসবে, কিন্তু একাধিকবার আসবে না। ফলে একবার এসেই একটি করে হলেও বই কিনবে। কেউ কেউ এর বিপক্ষেও মত দিলেন।

তবে মেলায় আসা সত্যিকারের ক্রেতা কিন্তু নিজের মতো করে বই কিনছেন। আগামী প্রকাশনীর বাংলা ভাষার সহজ পাঠ বইটি অধ্যাপক প্রতিভা রানী কর্মকারের লেখা। ১২টি অধ্যায়ে আছে বাংলা ভাষার উৎপত্তি থেকে শুরু করে বিকাশের ইতিহাস। আলাপের মধ্যেই বিক্রি হলো এক কপি। প্রথমা প্রকাশনের প্যাভিলিয়নের চারপাশের প্রদর্শনী টেবিলে তখন অনেক পাঠকের ভিড়। তাঁদের চাহিদার অগ্রভাগে ছিল গল্পে শেখা বাংলা ভাষা, জিপিএ ফাইভের চেয়েও জরুরি বা জহির রায়হানের যখন যন্ত্রণাসহ কয়েকটি বই।

গতকাল মেলার ১৮তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৭০টি। বিকেলে মূল মঞ্চে হয়েছে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গোলাম মুস্তাফা। সুব্রত বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে আলোচনা করেন মোহিত কামাল ও রাজীব সরকার।

আলোচনা অবশ্য মঞ্চের বাইরে মেলার মাঠেও জমছে রোজ। পাঠক সমাবেশের প্যাভিলিয়নে অনেক মানুষ আর গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতি ছিল। বাঙালির সামাজিক পদবীর ইতিহাস বা যমুনা সম্প্রদায়–এর মতো বইগুলো যাচ্ছে পাঠকের ব্যাগে। যমুনা সম্প্রদায় উপন্যাসের লেখক ইকতিয়ার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা লিটলম্যাগ চত্বরে। বললেন, বইটিতে আছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যমুনাপারের মানুষের প্রত্যাশার কথা। তবে মেলার ভিড় নিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলেন, মেলা প্রাণবন্ত কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থেকে কি দূরে চলে যাচ্ছে এ আয়োজন?

হতাশার এই সুরের নিরাময় হতে পারে কবিতা। আবুল হাসান লিখেছিলেন, অবশেষে জেনেছি মানুষ একা। সুরাইয়া খানম ষাটের দশকের শক্তিশালী কবি হলেও তাঁর নামটা বেশি পরিচিত আবুল হাসানের সূত্রেই। সুরাইয়া খানমের গ্রন্থিত–অগ্রন্থিত কবিতা বইটি পাওয়া যাবে জার্নিম্যান বুকস্‌–এর প্যাভিলিয়নে। সুরাইয়া খানম লিখেছিলেন, ‘এই গাছ কবিতা শোন আমার/ শোন পাথর, কবিতা শোন দেওয়াল...।’