শীর্ষ তিন বিজয়ীর অভিজ্ঞতা, আবেগ ও অর্জনের গল্প

‘আকিজ টেবিলওয়্যার আর্ট অব প্লেটিং সিজন-২’-এর চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজের নাম শোনার পর আবেগাপ্লুত মো. গোলাম রাব্বি।ছবি: আকিজ টেবিলওয়্যারের সৌজন্যে

প্লেটের ক্যানভাসে খাবার উপস্থাপনার জাদুই হলো ‘আর্ট অব প্লেটিং’। নতুন প্রজন্মের প্লেটিং-শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করতে ২০২২ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান আকিজ বশির গ্রুপ আয়োজন করে ‘আর্ট অব প্লেটিং সিজন-১ ’। প্রথমবার সাফল্যের পর এ বছরের এপ্রিলে আরও বড় পরিসরে এবং কঠিন কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে আয়োজিত হয় ‘আকিজ টেবিলওয়্যার আর্ট অব প্লেটিং সিজন-২’ প্রতিযোগিতা।

প্রায় ২৫ হাজার প্রতিযোগী অংশ নেয় এ আয়োজনে। প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ ২০০ জন প্রতিযোগী সুযোগ পান ঢাকায় গ্র্যান্ড অডিশনের। সেখান থেকে নির্বাচন করা হয় সেরা ৩০ জনকে। শুরু হয় একটি রোমাঞ্চকর রিয়েলিটি শো—যেখানে প্রত্যেকেই লড়েছেন ‘প্লেটিং মায়েস্ট্রো’ খেতাবের জন্য। বিচারকের আসনে ছিলেন মাস্টার শেফ ড্যানিয়েল সি গোমেজ এবং জনপ্রিয় কালিনারি আর্টিস্ট ও ট্রেইনার সাউদিয়া সুলতানা স্মিতা।

এবারের শীর্ষ তিনজন বিজয়ী—গোলাম রাব্বি, ইফ্ফাত জেরীন সরকার এবং রওজাতুর রুম্মানের অভিজ্ঞতা, আবেগ ও অর্জনের গল্প শুনেছেন দিনার হোসাইন হিমু

নিজের অবস্থান প্রমাণ করতেই রাব্বি আজ ‘প্লেটিং মায়েস্ট্রো’

গোলাম রাব্বির শৈশব কেটেছে বরিশালে। স্কুল-কলেজও ছিল সেখানেই। বর্তমানে তিনি পেস্ট্রি-শেফ হিসেবে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। তবে তাঁর ছোটবেলা মোটেও অন্য সবার মতো কাটেনি।

গোলাম রাব্বি বলেন, ‘মা মারা যাওয়ার কারণে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমার বড় হয়ে ওঠা। তবে অনেক মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। আর্ট অব প্লেটিংয়ে অংশগ্রহণটা ছিল সেই ভালোবাসারই একটি বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের একটি প্রতিযোগিতা হতে যাচ্ছে—আমার জানা ছিল না। মাসুম নামে আমার এক বড় ভাই এই প্রতিযোগিতার ফেসবুক পোস্টটি শেয়ার করে বলেন, তুমি এখানে অংশ নাও। আমি জানি তুমি পারবে। এভাবেই এখানে আসা।’

এই যাত্রায় কে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন? জানতে চাইলে রাব্বি বলেন, ‘প্লেটিং মায়েস্ট্রো হয়ে ওঠার পেছনে আমার অনুপ্রেরণা আমার ছেলে। তার জন্য আমি সব সময় এমন কিছু করতে চেয়েছিলাম যেন সে বাবাকে দেখে গর্ব করে।’

প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে গোলাম রাব্বি বলেন, ‘আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল টপ-টেন থেকে টপ-ফাইভে যাওয়া। মনে হয়েছিল, এ যাত্রা যেন এখানেই শেষ! এই পর্বে একটি আর্টকে খাবারের মাধ্যমে তুলে ধরতে হয়েছিল। প্রথমবার আমার প্লেটিং নষ্ট হয়ে যায়। পরে আবার আমাকে নতুন করে বানাতে হয়।’

চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার গ্রহণ করছেন মো. গোলাম রাব্বি।
ছবি: আকিজ টেবিলওয়্যারের সৌজন্যে

স্মৃতিচারণা করেন গোলাম রাব্বি, ‘ফাইনাল রাউন্ডটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। এই রাউন্ডে আমি সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটির মুখোমুখি হয়েছিলাম, তা হলো সময়। অল্প সময়ের মধ্যে তিনটি প্লেটিং করা খুব কঠিন ছিল। আর যাঁরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, সবাই নিজের জায়গা থেকে সেরা। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সহজ ছিল না।’  

প্লেটিং মায়েস্ট্রো খেতাব অর্জনের পর কেমন লেগেছে? প্রশ্নটি শুনেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রাব্বি বলেন, ‘আমি দেশের বাইরে অনেক শেফের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু দেশের শেফদের এমন ক্রাউন জিততে দেখিনি, এ জন্যই আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে।’
গোলাম রাব্বি বলেন, ‘যেহেতু আমি পেশায় একজন শেফ, তাই আমি মনে করি, আকিজ টেবিলওয়্যার আর্ট অব প্লেটিং সিজন-২ আসলেই আমাকে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। অনেকেই আগে আমার সম্পর্কে ‘ওহ, শেফ! রান্নাবান্না করে আরকি!’—এ রকম ভাবত। সব মিলিয়ে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমি নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছি। টাকার চেয়ে এই অর্জনই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

ছোটবেলার আগ্রহ থেকেই জেরিনের ‘প্লেটিং আইকন’ হয়ে ওঠা

ইফ্ফাত জেরীন সরকার, পড়াশোনা করছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে। পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠা তাঁর।

ইফ্ফাত বলেন, ‘রান্নার প্রতি আমার আগ্রহ ছোটবেলা থেকেই। এর প্রধান কারণ হলো আম্মু। আমি যখন ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি, তখন আম্মু সিদ্দিকা কবির ম্যামের কুকিং শোগুলো দেখতেন। আমিও আম্মুর সঙ্গে বসে বসে দেখতাম। খাবার তৈরি থেকে পরিবেশন—সবকিছুই অনেক উপভোগ করতাম। আবার এসব দেখে আম্মু আর আমি দুজনে নতুন নতুন ডিশ বানিয়ে প্লেটিংও করতাম।’

প্রথম রানারআপের পুরস্কার গ্রহণ করছেন ইফ্ফাত জেরীন সরকার।
ছবি: আকিজ টেবিলওয়্যারের সৌজন্যে

কীভাবে আর্ট অব প্লেটিংয়ের এই প্রতিযোগিতায় আসা হলো?
উত্তরে ইফ্ফাত জেরীন বলেন, ‘আকিজ টেবিলওয়্যার আর্ট অব প্লেটিং সম্পর্কে আমি জানতে পারি ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকে আসা একটি বিজ্ঞাপন থেকেই ওয়েবসাইটে ঢুকি। দেখে মনে হলো, একটি ডেজার্ট বানিয়েই ফেলি। যেই ভাবনা, সেই কাজ। একটি ফ্রুট টার্ট বানিয়ে ফেললাম। সেটাই সুন্দরভাবে প্লেটিং করে ছবি তুলে পাঠিয়ে দিই। শুরু হয় আকিজ টেবিলওয়্যার আর্ট অব প্লেটিং সিজন-২-তে আমার যাত্রা।’

প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ইফ্ফাত জেরীন বলেন, ‘প্রতিদিনই কিছু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। তবে ফাইনাল রাউন্ড আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল। প্রথম ১৬ মিনিট আমার সবজি কাটাকাটিতেই চলে যায়। শেষে এক মিনিট মাত্র অবশিষ্ট ছিল। ওই অল্প সময়েই আমি আমার ডেজার্টটি প্লেটিং করি।’

জানতে চাই, প্রথম রানারআপ হয়ে ‘প্লেটিং আইকন’ খেতাব জেতার অনুভূতি কেমন?
ইফ্ফাত জেরীন হাসিমুখে বলেন, ‘খেতাবটি জিতে বেশ বিপদেই পড়ে গেছি! কারণ, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে পরিবারের সবাই বলছে, তুমি তো এখন প্লেটিং আইকন, আমাদের কিছু বানিয়ে দাও। তা ছাড়া খাবার তৈরির পর কাউকে আর যেনতেনভাবে পরিবেশনও করা যাচ্ছে না।’

অর্জন তো হলো? এরপর জীবনের লক্ষ্য কী?
ইফ্ফাত জেরীন বলেন, ‘প্যাশন আর প্রফেশন যখন মিলে যায়, তখন জীবনে সফল হওয়া সহজ। কুকিং আর বেকিং সব সময়ের জন্য ছিল আমার ভালোলাগার জায়গা। আমি এখনো পড়াশোনা করছি। স্বপ্ন দেখি একদিন নামকরা শেফ হব।’

চিকিৎসক রওজাতুর এখন ‘প্লেটিং ম্যাভেরিক’ও

ছোট্ট শহর যশোরে বেড়ে ওঠা রওজাতুর রুম্মানের। তিনি যশোরে উদীচী পরিচালিত অক্ষর শিশু শিক্ষালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন।

বর্তমানে পেশায় চিকিৎসক রওজাতুর রুম্মান বলেন, ‘আমার ছবি আঁকা, গান শেখা এবং আর্টের প্রতি ভালোবাসা—সবকিছু উদীচী থেকেই পাওয়া। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করি। তবে আর্টের প্রতি ভালোবাসা থেকেই যায়।’

দ্বিতীয় রানারআপের পুরস্কার গ্রহণ করছেন রওজাতুর রুম্মান।
ছবি: আকিজ টেবিলওয়্যারের সৌজন্যে

আকিজ টেবিলওয়্যার আর্ট অব প্লেটিং সিজন-২ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে রওজাতুর রুম্মান বলেন, ‘চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি রান্নার প্রতিও ছিল ভালোবাসা। আমার স্বামী আমার হাতের রান্না খুব পছন্দ করেন। তাই কাজের ফাঁকে সময় পেলে তাঁর জন্য রান্না করি, সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করি। আর খাবারের সব স্মৃতি ছবি তুলে ফোনের গ্যালারিতে রেখে দেওয়া আমার একটি শখের মতো। মজার ব্যাপার হলো, গ্যালারিতে থাকা একটি পছন্দের ছবিই আমি এখানে সাবমিট করি। ২৫ হাজার জনের মধ্যে আমার ছবিটি যে সিলেক্টেড হবে—ভাবতেই পারিনি।’

দ্বিতীয় রানারআপ হয়ে ‘প্লেটিং ম্যাভেরিক’ খেতাব জেতেন রওজাতুর রুম্মান। অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার আগে জানতাম একজন হবে প্লেটিং মায়েস্ট্রো। কিন্তু আমাকে যখন “প্লেটিং ম্যাভেরিক” খেতাব দেওয়া হলো, বিস্মিত হয়েছি! এখন পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব যেভাবে ভালোবাসা দিচ্ছে, তাতে চিকিৎসক পেশার পাশাপাশি আর্ট অব প্লেটিং নিয়েও ভবিষ্যতে কিছু করার ইচ্ছা আছে।’