গণতন্ত্র ও সাহসিকতাই খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের শিক্ষা

‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড: ফিরে দেখা’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা দিচ্ছেন ইতিহাসবিদ ও গবেষক গৌতম রায়। তাঁর বাঁয়ে অধ্যাপক এম এম আকাশ ও ডানে সঞ্চালক বৃত্বা রায়। শুক্রবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ড ছিল উপমহাদেশে প্রথম জেলহত্যা। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে নিরস্ত্র কারাবন্দীদের ওপর যে নির্বিচার গুলি চালনা ও লাঠিপেটা করা হয়েছিল, ইতিহাসে সেটি এক বর্বরতম হত্যা–নির্যাতনের ঘটনা। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে আয়োজিত স্মারক বক্তৃতায় গৌতম রায় এ কথা বলেন। ভারতের কলকাতার দৈনিক কালান্তর পত্রিকার প্রবীণ সাংবাদিক এবং বামপন্থী ইতিহাসবিদ ও গবেষক গৌতম রায় ছিলেন ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড: ফিরে দেখা’ শীর্ষক স্মারক বক্তা।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খাপড়া ওয়ার্ড ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক এম এম আকাশ। তিনি সূচনা বক্তব্যে জানান, প্রতিবছরের ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ড দিবস উপলক্ষে বক্তৃতা ও বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। দিনটিতে খাপড়া ওয়ার্ডে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, স্বজন, সুহৃদেরা অংশ নেন। এদিন মিলনমেলার মতো পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তবে এ বছর ওই সময় পবিত্র রমজান মাস চলতে থাকায় অনুষ্ঠানটি করা যায়নি। তার বদলে এখন এই স্মারক বক্তৃতা হচ্ছে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বৃত্বা রায়।

গৌতম রায় লিখিত বক্তব্যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবীদের ভূমিকা ও কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁদের অংশগ্রহণের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের বিপ্লবী কারা, তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় নাগরিকদের অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করে আইন করে। তখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত শহরে অনেক আখড়া বা শরীরচর্চাকেন্দ্র গড়ে ওঠে। সেখানে কুস্তি, লাঠিখেলা, অসি চালনা—এসব শেখানো হতো। এই আখড়াগুলোকে কেন্দ্র করেই বহু বিপ্লবী সমিতি গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসকদের চোখে এই বিপ্লবীরা ছিলেন সন্ত্রাসবাদী।
গৌতম রায় বলেন, ১৯২০ সালে এম এন রায় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলে অন্যদের সঙ্গে এই বিপ্লবীরা তাতে যোগ দেন। তাঁরাই ছিলেন সংখ্যাগুরু। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, গান্ধীজির (মহাত্মা গান্ধী) অহিংস পথে ব্রিটিশ শক্তিকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। খাপড়া ওয়ার্ডে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে ছিলেন বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজশাহী অনুশীলন সমিতির সদস্য। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের পরপরই পশ্চিমবঙ্গ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে। তখন কারাবন্দী নেতা–কর্মীদের জেলের ভেতরেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে নির্দেশনা দেয় পার্টি। পূর্ববঙ্গের জেলবন্দী কমিউনিস্টদের কাছে এটি ‘জেল বিপ্লব’ নামে পরিচিতি পায়।

‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড: ফিরে দেখা’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক এম এম আকাশ। শুক্রবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে
ছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে তখন বহু স্বাধীনতাসংগ্রামী বিপ্লবী তথা অনুশীলন সমিতির সদস্য কারাবন্দী ছিলেন। এই কারাগার তৈরি করা হয়েছিল ১৮৪০ সালে। ফলে কারাগারে সরকারবিরোধী একটি পরিবেশ আগে থেকেই ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা–কর্মীরা এখানে বন্দী হয়ে আসেন। তাঁদের রাখা হয়েছিল কারাগারের প্রধান চত্বর থেকে খানিকটা দূরে আলাদাভাবে। সেটি লম্বা একটি ঘর। মাটি থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। এর ছাউনি ছিল খাপড়া বা টালির তৈরি। সে কারণেই এর নাম হয়েছিল খাপড়া ওয়ার্ড। ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের সময় ৪৩ জন বন্দী ছিলেন সেখানে। তাঁরা সবাই ছিলেন সমমনা।
 
কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা সব কারাবন্দীর ওপর নির্যাতন বন্ধ ও অন্যান্য দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের নেতা ছিলেন খাপড়া ওয়ার্ডের আবদুল হক। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের খাপড়া ওয়ার্ড থেকে অন্য ওয়ার্ডে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আন্দোলনরত কারাবন্দীরা খাপড়া ওয়ার্ড ছাড়তে সম্মত ছিলেন না। ২৪ এপ্রিল সকাল নয়টায় জেল সুপার ডব্লিউ এফ বিল দুই ডেপুটি জেলার ও একজন চিকিৎসককে নিয়ে খাপড়া ওয়ার্ডে আসেন। তাঁরা আবদুল হকের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। এমন সময় দুজন বন্দী প্রবেশপথের দিকে যাচ্ছিলেন। বিল তাঁদের ধাক্কা দিয়ে দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যান। কেউ একজন তীক্ষ্ণ শব্দে হুইসেল বাজিয়ে দেন। বন্দীরা বিস্মিত হয়ে দেখেন, দুই পাশের দেয়ালের পাশের জানালা দিয়ে কারারক্ষীরা তাঁদের দিকে রাইফেল তাক করেছেন।

গৌতম রায় বলেন, খাপড়া ওয়ার্ডে ৬০টি গুলি করা হয়েছিল। সেখানেই মারা যান দিলওয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, হানিফ শেখ, বিজন সেন, সুধীন ধর, ছাত্রনেতা সুখেন ভট্টাচার্য ও কম্পরাম সিংহ। কমবেশি আহত হয়েছিলেন প্রায় সবাই। গুলির পর তাঁদের লাঠিপেটা করা হয়েছিল। লম্বা সময় তাঁদের ওই কক্ষেই ফেলে রাখা হয়েছিল। পরে স্থানীয় পুলিশ সুপার, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ছিলেন, তিনি তাঁর রিপোর্টে মন্তব্য করেছিলেন, তিনি অনেক মৃত্যু দেখেছেন, তবে নিরস্ত্র ও অসহায় মানুষকে এভাবে গুলি করে মারার কোনো নজির তাঁর জানা নেই।

স্মারক বক্তৃতার উপসংহারে গৌতম রায় বলেন, খাপড়া ওয়ার্ডের এই ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় হলো গণতান্ত্রিক নীতিকে মর্যাদা দেওয়া। গুলির ঘটনার আগেই বন্দীদের মধ্যে ভোটাভুটি হয়েছিল খাপড়া ওয়ার্ড ছাড়া হবে কি না, তা নিয়ে। না ছাড়ার পক্ষেই বেশির ভাগ ভোট পড়েছিল। একটি সহিংসতার আশঙ্কা তাঁরা করেছিলেন এবং সাহসিকতার সঙ্গে তার মোকাবিলা করেছেন। এই গণতান্ত্রিকতা ও সাহসিকতা—এটাই খাপড়া ওয়ার্ডের হত্যাকাণ্ড থেকে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষণীয়। মাও সে–তুংয়ের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘চীনের এই কিংবদন্তি কমরেড বলেছিলেন, “কারও মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা, কারও মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারী।” আমাদের মনে রাখতে হবে, খাপড়া ওয়ার্ডে যে রাজবন্দীদের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁদের মৃত্যু ছিল থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারী।’

সমাপনী বক্তব্যে এম এম আকাশ বলেন, ‘খাপড়া ওয়ার্ডের শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের ওপর অনেক বড় দায়িত্ব অর্পণ করেছে। আমাদের সেই দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।’

‘পূর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির গোড়ার কথা’ বই নিয়ে আলোচনা
শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মুক্তি ভবনের এই মৈত্রী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে গৌতম রায়ের লেখা ‘পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির গোড়ার কথা (১৯৪৭-১৯৬৭)’ বই নিয়ে আলোচনা। বইটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। লেখক গৌতম রায়সহ সিপিবির জ্যেষ্ঠ নেতারা আলোচনায় অংশ নেবেন।