মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০ জন গ্রেপ্তার, নতুন ১৭ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ১৭ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল আজ রোববার এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। পৃথক আবেদনের শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেওয়া হয়। আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। গত জুলাই ও আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
পুনর্গঠনের পর পুরাতন হাইকোর্ট ভবন এলাকায় স্থাপিত ট্রাইব্যুনালের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ১৭ অক্টোবর। সেদিন পৃথক দুটি আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
ট্রাইব্যুনালে আজকে পর্যন্ত তিনটি মিস কেস (বিবিধ মামলা) করা হয়েছে। প্রথম দিন (১৭ অক্টোবর) দুটি বিবিধ মামলা হয় এবং গতকাল হয় একটি। প্রথম বিবিধ মামলায় আসামি হিসেবে আছেন শেখ হাসিনা এবং দ্বিতীয় বিবিধ মামলায় আছেন সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সাবেক মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য। তৃতীয় বিবিধ মামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আসামি হিসেবে রয়েছেন।
আজ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের শুরুতেই দুটি আবেদনে ২০ জনকে গ্রেপ্তার দেখানোর আরজি জানান চিফ প্রসিকিউটর। প্রথম আবেদন সম্পর্কে আদালতকে তাজুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার আমলের ১৪ জন সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, বিচারক ও আমলার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁরা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার আছেন। তাঁদের বিবিধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন জানান তিনি। তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার এই ১৪ জনের গ্রেপ্তারের আবেদন মঞ্জুর করেন।
তাঁরা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক; সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক সংসদ সদস্য শাজাহান খান, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. জাহাংগীর আলম। এই ১৪ জনকে আগামী ১৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে নির্দেশনা দেওয়ার আরজি জানান চিফ প্রসিকিউটর, পরে আদালত তা মঞ্জুর করেন।
দ্বিতীয় আবেদনে আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আরজি জানান চিফ প্রসিকিউটর। তাঁরা হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, বরখাস্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, পুলিশ কর্মকর্তা আরাফাত হোসেন, আবুল হাসান ও মাজহারুল ইসলাম।
আদালতকে তাজুল ইসলাম বলেন, এই ছয়জন বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারপর তাঁদের গ্রেপ্তার আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। এই ছয়জনকে ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর ১৭ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জানান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। ছাত্র–জনতার আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে তাঁরা ভূমিকা রেখেছেন বলে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন। পালিয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় সবার নাম প্রকাশ করেননি তিনি। পরে ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন মঞ্জুর করেন। এই কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করে ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর।
পরে ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এ মামলায় যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, শুধু তাঁদেরই গ্রেপ্তার দেখানো এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করা হচ্ছে। যেসব পুলিশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না, তাঁদের ভয়ভীতির কারণ নেই।