মুক্তিযোদ্ধাদের চুল-দাড়ি বিনা মূল্যে কাটেন গোপাল চন্দ্র
রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে গোপাল চন্দ্র শীলের সেলুনটি ছোট পরিসরের। দোকানে ওঠার সিঁড়ি, বাইরের অংশ ও পিলারে রয়েছে নানা রঙের আলপনা। হাঁটতে গেলেই চোখে পড়বে দোকানটি।
তবে নজর কাড়ার অন্যতম কারণ হলো দোকানের বাইরে বড় সাইনবোর্ডে লাল-সবুজ রঙে লেখা ‘এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্রি চুল কাটা হয়’। দোকানের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন ছবি, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার ছবিও আছে। গোপাল বলেন, তিনি দুই দশকের বেশি সময় ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের চুল-দাড়ি বিনা মূল্যে কাটছেন।
গোপালের বাড়ি ঝালকাঠির কাঠালিয়া উপজেলায়। বয়স ৪৮ বছরের মতো। তিনি জীবিকার সন্ধানে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ঢাকায় আসেন। ভাড়া নেন পশ্চিম আগারগাঁওয়ে মোমতাজ মসজিদের পাশে ছোট্ট এই দোকান। তখন থেকে এখনো এই সেলুন চালাচ্ছেন। গোপালের দোকানে মুক্তিযোদ্ধাদের চুল বিনা মূল্যে কাটানোর বিষয়টি এলাকায় বেশ আলোচিত।
মুক্তিযুদ্ধের বছর তিনেক পরে গোপাল চন্দ্রের জন্ম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুদ্ধ তো আমরা দেখি নাই। বাপ-দাদার কাছে গল্প শুনেছি। টেলিভিশনে দেখেছি, কত কষ্ট করে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন। তাঁদের জন্য সেভাবে কিছু করার সুযোগ পাইনি। নিজের জায়গা থেকে বিনা মূল্যে চুল কেটে সম্মান জানানোর চেষ্টা করছি।’
গোপালের সেলুনের নাম ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সেলুন’। ১৪ ডিসেম্বর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দোকানে এক গ্রাহকের চুল কাটছেন গোপাল। বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে তাঁর গায়ে ছিল লাল-সবুজ রঙের ফুলহাতা পলো শার্ট। দোকানে আয়নার ওপরের দিকে ও পাশে সত্তরের নির্বাচন, ৭ মার্চ, গেরিলা যুদ্ধ, শরণার্থীশিবির শিরোনামে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ছবি টানানো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ছবিও রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চুল কাটছেন—এমন কয়েকটি ছবিও টানিয়ে রেখেছেন তিনি। চুল কাটার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে জড়ানোর জন্য রাখা হয়েছে বাংলাদেশের পতাকার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লাল-সবুজ কাপড়।
গোপাল চন্দ্র বলেন, তিনি এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধার চুল–দাড়ি কেটেছেন। এর মধ্যে সচ্ছল অনেক মুক্তিযোদ্ধা জোর করে টাকা দিয়ে গেছেন। কোনো মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থ হলে তাঁর বাড়িতে গিয়েও চুল কেটেছেন, বললেন গোপাল। তাঁর দোকানে দুজন সহকারী। গোপালের অনুপস্থিতিতে সহকারীরাও যেন মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে টাকা না নেন, তা বলা আছে এবং তাঁরা সেটা করেনও।
কেউ যখন সেলুনে এসে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দেন গোপাল তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর কাছে যুদ্ধের গল্প শোনেন। শুধু যে মুক্তিযোদ্ধারা চুল–দাড়ি কাটিয়ে চলে যান তা নয়, সেলুনে চুল–দাড়ি কাটাতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুভূতি লেখার জন্য ডায়েরি আছে। তাতে মুক্তিযোদ্ধারা গোপালের এই উদ্যোগ সম্পর্কে নিজেদের মতামত লিখেছেন। তাঁদের লালমুক্তি বার্তা নম্বর, বেসামরিক গেজেট নম্বর লিখেছেন। এমনই একজন নেলসন রেমা। ডায়েরিতে তিনি তাঁর লালমুক্তি বার্তা নম্বর, গেজেট নম্বর লিখে রেখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে গোপালের দেশপ্রেম জাগরিত হোক। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রজন্মের পর প্রজন্ম গোপালের মতো ধারণ ও বহমান থাকুক।’
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নেলসন রেমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েকবার গোপাল চন্দ্রের সেলুনে গিয়েছি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সে খুব আন্তরিক। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে গোপাল বেশ নিবেদিত।’
সেলুনের ওপরের তলার একটা কক্ষে গোপাল চন্দ্র থাকেন। তাঁর বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই মেয়ে ঝালকাঠিতে থাকেন। বর্তমানে সেলুনের মাসিক ভাড়া ৮ হাজার টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে গোপালের আয়ে সংসার চলে যায়। গোপাল বলেন, ‘বাকি জীবনও মুক্তিযোদ্ধাদের চুল বিনা মূল্যে কেটে যেতে চাই।’
পশ্চিম আগারগাঁও সমাজকল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গোপাল চন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে সেলুনটি চালান। যাঁরা দেশকে স্বাধীন করেছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের গোপালের সম্মান জানানোর বিষয়টি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।