মেয়ের সৎকার শেষে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে

শ্রাবন্তী সরকার। ১৯ জুলাই তার ১২ বছর হওয়ার কথা ছিল
ছবি: পরিবার থেকে সংগৃহীত

কী উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটছিল শ্রাবন্তী! নামের অর্থের মতোই প্রবহমান। ঈদের ছুটিতে বেড়াতে যাবে, এ নিয়ে সে কী উত্তেজনা! পরিবারের সবার সঙ্গে ছুটেও গিয়েছিল ভারতের ত্রিপুরায়। তবে যে আনন্দ নিয়ে যাত্রা, তা দীর্ঘায়িত হয়নি। অসুস্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। ছয় দিনের ডেঙ্গু জ্বরে গতকাল মঙ্গলবার রাতে থেমে যায় শ্রাবন্তী নামের উচ্ছল প্রবাহটি।

শ্রাবন্তী সরকার নগরের সেন্ট স্কলাস্টিকা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। এক ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছোট। বড় ভাই সৌভিক সরকার সরকারি বাণিজ্য কলেজের উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। বাবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। মা গৃহিণী।

সদ্য সন্তানহারা মা বিটু সরকারের যেন শোক প্রকাশ করারও সুযোগ নেই। কারণ, অপর সন্তান সৌভিকও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। রাতেই বলুয়ার দিঘি মহাশ্মশানে মেয়ের সৎকার সেরে ছেলেকে রাত একটার দিকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। আজ বুধবার সকালে নগরের ম্যাক্স হাসপাতালের ১০০৪ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সৌভিকের স্যালাইন চলছে। ছেলের পাশে বিষাদমাখা চেহারায় বসে আছেন মা। কেবল হাতড়ে বেড়াচ্ছেন শ্রাবন্তীর স্মৃতি।

মেয়ের কথা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন এই মা। তিনি বলেন, ‘বেড়াতে গিয়েছিলাম ত্রিপুরায়। বেড়াতে যাওয়ার জন্য কী আগ্রহ তার। কিন্তু জ্বর নিয়ে ফিরে আসে। ডেঙ্গু ধরা পড়ে সোমবার। বাসায় মারা গেল মেয়েটি। ডাক্তার বলেছিল ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আর সময় দিল না মা আমার।’

হাসপাতাল কেবিনের অপর শয্যার পাশে বিটুর বড় বোন বিউটি ঘোষ বসে আছেন। কারণ, তাঁর মেয়ে সামান্তা ঘোষেরও জ্বর। ঈদের ছুটিতে ২৭ জুন দুই বোনের পরিবার বেড়াতে গিয়েছিল ত্রিপুরায়। বেড়াতে যাওয়ার দুই দিন আগেই সামান্তার জ্বর ছিল। পরে কমে যায়। সেখানে যাওয়ার পর ২৯ জুন জ্বরে আক্রান্ত হয় শ্রাবন্তী। বেড়ানো সংক্ষিপ্ত করে শুক্রবারই ফিরে আসে আটজনের দলটি।

বেড়াতে গিয়ে মা–বাবা–ভাইয়ের সঙ্গে শ্রাবন্তীর তোলা এই ছবি এখন শুধুই স্মৃতি
ছবি: পরিবার থেকে সংগৃহীত

বিউটি ঘোষ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে গেলাম। ওই দিনই জ্বর আসে শ্রাবন্তীর। পরদিন ফিরে আসি। শনিবার এখানে ডাক্তার দেখানো হয়। এরপর মঙ্গলবার বিকেলেও চিকিৎসক দেখানো হলো। তিনি হাসপাতালে ভর্তির জন্য বলেননি। ওই রাত পৌনে ৯টায় সব শেষ হয়ে যায়।’

মঙ্গলবার শ্রাবন্তীর মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছিল। পেট ফুলে গিয়েছিল। খালাতো বোন এমবিবিএসের ছাত্রী সামান্তার ধারণা, এখান থেকে আক্রান্ত হয়েই তারা ত্রিপুরা যায়। কারণ, যাওয়ার দুই দিন আগে তাঁর জ্বর আসে। পরে আস্তে আস্তে শ্রাবন্তী ও সৌভিকের হয়।

চট্টগ্রাম নগরের ম্যাক্স হাসপাতালের জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তা পুষ্পল দত্ত বলেন, সৌভিকের অবস্থা এখন ভালো। সামান্তার ডেঙ্গু হয়েছে কি না, তা জানতে তার রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।

বিটু সরকারের আফসোস, কেন মেয়েকে আগেভাগে হাসপাতালে ভর্তি করালেন না। ১৯ জুলাই শ্রাবন্তীর ১২ বছর হওয়ার কথা ছিল। মেয়ে নেই, বিশ্বাস করতে পারছেন না এই মা। ত্রিপুরায় মেয়ের সঙ্গে তোলা ছবিগুলো এখনো যেন কথা বলছে।

হাসপাতালের কেবিনের জানালা দিয়ে সবুজ পাহাড় আর মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘কই কোথাও তো দেখছি না আমার মেয়েটিকে।’

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে শ্রাবন্তীসহ ১২ জনের মৃত্যু হলো। আজ বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায়  নতুন করে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৪৮ জন। বর্তমানে চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১২৬ জন। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৬৬১ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন