প্রতিরোধের অভাবে সংকট বাড়ছে নারীর

  • এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসুন, সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’।

  • ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ১৫ দিনের এই পক্ষ শেষ হবে।

নারীর প্রতীকী ছবি

এক নারীর ক্রমাগত কান্নার শব্দ শুনছিলেন মোটরসাইকেল পরিষ্কার করতে থাকা এক ব্যক্তি। বেশ কয়েকবার দ্বিধা করে শেষ পর্যন্ত ওই ব্যক্তি বাড়িটির কলবেলে চাপ দেন। শব্দ পেয়ে স্বামীর মার বন্ধ হয়। ‘রিং দ্য বেল’ (বেল বাজান) স্লোগান নিয়ে এমন একটি বিজ্ঞাপন ১৫ বছর আগে টেলিভিশনে প্রথম প্রচার শুরু করে ভারত। কলবেল বাজানোর বিষয়টি ছিল রূপক অর্থে। মূল লক্ষ্য ছিল, পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা দেখা মাত্র কেউ যেন বাধা দেন।

এখন বিশ্বের অনেক দেশে নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো নির্যাতন ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ‘রিং দ্য বেল’ ধারণা ব্যবহৃত হচ্ছে।
চট্টগ্রামে মায়ের সামনে থেকে এক কিশোরীকে অপহরণের ঘটনা ব্রেক থ্রো সংস্থার রিং দ্য বেল বিজ্ঞাপনটির কথা মনে করিয়ে দিল। কারও বিপদ দেখলে পাশ কাটানোর প্রবণতা আছে অনেকের। কোনো নির্যাতনের ঘটনাকে ‘ব্যক্তিগত বিষয়’, কোনো নির্যাতনের ঘটনায় নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে অনেকে দূরে থাকেন। ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে এক মায়ের কাছ থেকে তাঁর কিশোরী মেয়েকে অপহরণ করা হয়। ওই মা ‘আল্লাহ, আল্লাহ গো’ চিৎকার করে অপহরণকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আশপাশে লোকজন থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেননি।

মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়ে ২৫ নভেম্বর শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ।

মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়ে ২৫ নভেম্বর শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালনের মধ্য দিয়ে ১৫ দিনের এই পক্ষ শেষ হবে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে এগিয়ে আসুন, সহিংসতা প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন’।

দেশে নারী নির্যাতনের উদ্বেগজনক চিত্রের তুলনায় ব্যক্তিগত প্রতিরোধ কম। আর সরকারি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দুর্বল। সেই সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতি নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো কমাতে যথাযথ ভূমিকা রাখছে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৯ হাজার ৫৬টি, ২০২১ সালে ২২ হাজার ১২৪টি, ২০২০ সালে ২২ হাজার ৫০১টি, ২০১৯ সালে ২৭ হাজার ৭৫২টি, ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ২৩৪টি মামলা হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১৮ হাজার ৫৩টি মামলা হয়েছে। এ বছর ও গত বছর মামলার ৫২ শতাংশ ধর্ষণের, আগের চার বছরে এ হার ৪৮ শতাংশের নিচে ছিল।  

‘আমি ফাঁসি চাই’

গত বছরের ২ আগস্ট দিবাগত রাতে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাসটিকে ফেলে যায় ডাকাতেরা। চলন্ত বাসে ডাকাতির সময় একমাত্র প্রতিবাদ করা ব্যক্তি ২৯ বছর এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। তিনি পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলেন। ওই নারী ২০ নভেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রী ছিলেন ২৪ জন। আর ডাকাত ১১ জন। অস্ত্রের ভয়ে সবাই চুপ ছিলেন। তবে সবাই মিলে সাহস করে যদি এগিয়ে আসতেন, তাহলে তাঁর সঙ্গে ঘটনাটি ঘটত না। তিনি বলেন, ‘আমি ধর্ষকদের ফাঁসি চাই। ফাঁসি ছাড়া আমার আর কোনো চাওয়া নেই। ফাঁসি হলেই অন্যরা এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পাবে না। এক বছরের বেশি হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত মামলার বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’

টাঙ্গাইলের গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) ওসি মো. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ১১ জন ডাকাতের মধ্যে ৪ জন ধর্ষণ করেছে বলে ডিএনএ পরীক্ষায় এসেছে। ডাকাতি, ধর্ষণ ও ধর্ষণের সহযোগী হিসেবে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আসামিরা কারাগারে আছে কি নেই, সেটা আদালত বলতে পারবেন।

ঘটনার দিন বাসের যাত্রী ও মামলার বাদী মো. হেকমত আলী (২৮) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামিরা কোথায়, মামলার কী অবস্থা, আমি কিছু জানি না। আমি ওই ঘটনা ভুলে যেতে চাই। ঘটনার আড়াই মাস পর সাক্ষ্য দিতে থানায় গিয়ে ভালো ব্যবহারও পাইনি।’ ধর্ষণের শিকার নারীর প্রসঙ্গ তুলতে বললেন, ‘অস্ত্রের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কারও প্রতিবাদ করার অবস্থা ছিল না। ওই নারীর মতো আরও কয়েকজন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বাধা দিতে পারিনি মনে হলে খারাপ লাগে।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সংকলিত করে জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে নারী নির্যাতনের ১ হাজার ২১৮টি খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনার ৪১ শতাংশ ধর্ষণের ও ৩৬ শতাংশ পারিবারিক নির্যাতনের।

নারী নির্যাতনের যেকোনো ঘটনায় ব্যক্তি প্রতিরোধ যেমন কম, তেমনি সরকারি প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমগুলো খুব দুর্বল। নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিরোধমূলক কাজের নেতৃত্বে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’ নামের প্রকল্পটি এ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। তবে ২২ বছর চলার পর প্রকল্পটি এ বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এক বছর ধরে প্রকল্প থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে টানাপোড়েনে কাজে গতি কমেছে। কোভিডে ব্যয় সংকোচনের ধাক্কায় প্রকল্পের বাজেট কমে সচেতনতামূলক প্রচার ও পুনর্বাসন বাদ দেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৩০ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এডিপি বরাদ্দ ২১ কোটি টাকা।

আচরণগত পরিবর্তন দায়ী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন সহযোগী অধ্যাপক শাহারিয়া আফরিন প্রথম আলোকে বলেন, সমাজব্যবস্থা এখন পুঁজিভিত্তিক, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান অনেকে। এখন অনেকে ঝুঁকি তখনই নিতে চান, যখন তাঁর লাভ বেশি। অনেকে মনে করেন, তিনি ওই নারীর ওপর নির্যাতন প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিজের বিপদ কেন ডেকে আনবেন। ঘটনা ঘটলে দ্রুত বিচার হওয়া, অপরাধীর সহজে ছাড়া না পাওয়া, ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত হলে মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ করার প্রবণতা বাড়ত।