সাংবাদিকতায় ‘হিরোদের’ তালিকায় রোজিনা ইসলাম

সিএফডব্লিউআইজের দৃষ্টিতে সাংবাদিকতায় ‘হিরো’ প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম
ছবি: সিএফডব্লিউআইজের সৌজন্যে

বিশ্বজুড়ে যেসব নারী সাংবাদিকতায় সাহসের সঙ্গে সত্য প্রকাশ করে চলেছেন, তাঁদের সম্মান জানিয়েছে দ্য কোয়ালিশন ফর উইমেন ইন জার্নালিজম (সিএফডব্লিউআইজে)। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (৮ মার্চ) বিভিন্ন দেশের ২০ জন নারী সাংবাদিককে সাংবাদিকতায় ‘হিরো’ হিসেবে বর্ণনা করেছে তারা। নিউইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সিএফডব্লিউআইজে সারা বিশ্বে নারী সাংবাদিকদের সহায়তায় কাজ করে।

‘জার্নোহিরো’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ওই ২০ নারী সাংবাদিকের পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে সিএফডব্লিউআইজে। এই তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম রয়েছেন। সিএফডব্লিউআইজে ২০১৯ সালে প্রথম ‘জার্নোহিরো’ প্রচারণা শুরু করেছিল।

সিএফডব্লিউআইজের দৃষ্টিতে সাংবাদিকতায় হিরোদের তালিকায় আছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা
ছবি: সিএফডব্লিউআইজের সৌজন্যে

এ বছর তাদের তালিকায় থাকা অন্য নারী সাংবাদিকেরা হলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ফিলিপাইনের সাংবাদিক মারিয়া রেসা, যুক্তরাষ্ট্রের সেরিস ক্যাসল, আমনা নওয়াজ, ভারতের রানা আইয়ুব, রাশিয়ার মারিয়া পোনোমারেঙ্কো, ইউক্রেনের সেভগিল মুসাইয়েভা, মিয়ানমারের হতেত হতেত খিন, ইরানের নিলুফার হামেদি, তুরস্কের আমবেরিন জামান, পাকিস্তানের নাসিম জেহরা, তুরস্কের সাফিয়ে আলাগাস, মিসরের সোলাফা মাগদি, ভারতের বারখা দত্ত, চীনের সোফিয়া হুয়াং সুয়েকিন, যুক্তরাষ্ট্রের নিকোল হানাহ–জোনস, কানাডার অ্যাম্বার ব্রাকেন, এরিকা ইফিল, সাবা এইতিজাজ ও যুক্তরাষ্ট্রের মারি কোলভিন।

সিএফডব্লিউআইজে বলছে, সহিংসতা ও সেন্সরশিপের হুমকি সত্ত্বেও এই নারী সাংবাদিকেরা প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁরা এমন অনেক ঘটনা প্রকাশ করেছেন, যেগুলো তাঁরা না করলে আড়ালেই থেকে যেত।

সিএফডব্লিউআইজের দৃষ্টিতে সাংবাদিকতায় ‘হিরো’ ভারতের রানা আইয়ুব
ছবি: সিএফডব্লিউআইজের সৌজন্যে

প্রায় ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েই এই নারী সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার মূলনীতিগুলো সত্য, যথার্থতা, স্বাধীনতা, পক্ষপাতহীন, মানবিকতা ও জবাবদিহিকে সামনে তুলে ধরেছেন। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তাঁরা ভুল তথ্যের লাগাম টেনে ধরার পাশাপাশি আরও ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন।

রোজিনা ইসলাম সম্পর্কে সিএফডব্লিউআইজে বলেছে, বাংলাদেশি অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম দেশটির শীর্ষ সংবাদপত্র প্রথম আলোতে কাজ করেন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি প্রতিবেদন করেছেন। ২০২১ সালের মে মাসে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে মামলা করা হয়েছে। রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তার ও মামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যম তাঁকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানায়। রোজিনা ইসলাম কিছুদিনের মধ্যে জামিন পেলেও তাঁকে মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে। তাঁর এই মামলা বাংলাদেশে সাংবাদিকদের যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, তার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সিএফডব্লিউআইজের দৃষ্টিতে সাংবাদিকতায় ‘হিরো’ রাশিয়ার মারিয়া পোনোমারেঙ্কো
ছবি: সিএফডব্লিউআইজের সৌজন্যে

সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ২০২১ সালের ১৭ মে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আক্রমণের শিকার হন। তাঁকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে তাঁকে শত বছরের পুরোনো ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে’ গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলা তদন্ত করে গত বছরের জুলাইয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। রোজিনা ইসলামকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানিয়ে তাতে বলা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সপক্ষে কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।

সিএফডব্লিউআইজের দৃষ্টিতে সাংবাদিকতায় ‘হিরো’ ইউক্রেনের সেভগিল মুসাইয়েভা
ছবি: সিএফডব্লিউআইজের সৌজন্যে

চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি এ মামলার বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী ওই প্রতিবেদনে নারাজি দেন। আদালত তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে রোজিনা ইসলামকে হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য–বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন।

রোজিনা ইসলাম ‘সেরা অদম্য সাহসী’ হিসেবে ২০২১ সালে ফ্রি প্রেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এ ছাড়া গত বছরের ৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ২০২২ সালের ‘অ্যান্টিকরাপশন চ্যাম্পিয়নস অ্যাওয়ার্ড’ পান তিনি।

নারী সাংবাদিকদের বাধা পেরোতে সহায়তা করবে ভালো সাংবাদিকতা চর্চা

নারী সাংবাদিকদের জন্য বর্তমান সময়ে কাজ করা বিশেষভাবে বিপজ্জনক। এই পেশায় নারীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। ভালো সাংবাদিকতা চর্চা এসব বাধাবিপত্তি পেরোতে সহায়তা করবে। নতুন সাংবাদিকদের সব সময় কৌতূহলী ও সক্রিয় থাকতে হবে। সত্যের সন্ধানে কখনো ভীত হওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বুধবার বিশ্বের আটজন অনুসন্ধানী নারী সাংবাদিকের বক্তব্য প্রকাশ করে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন)। সেখানে এসব কথা বলেছেন ওই সাংবাদিকেরা।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা জিআইজেএন বুধবার তাদের ফেসবুকে ওই আট নারী সাংবাদিকের বক্তব্য প্রকাশ করেছে। তাঁদের মধ্যে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামও রয়েছেন।

রোজিনা ইসলাম বলেছেন, ‘নারী সাংবাদিকদের কাজ করার জন্য এখন বিশেষভাবে বিপজ্জনক সময়। এই পেশায় থাকা নারীদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। হুমকি, মামলা ও অনলাইনে হয়রানি ছাড়াও নারী সাংবাদিকদের পড়তে হয় মানহানির মুখে। আমার মনে হয়, ভালো সাংবাদিকতার চর্চা এসব বাধাবিপত্তি পেরোতে সহায়তা করবে।’

জিআইজেএনের প্রকাশিত বক্তব্যে নতুন সাংবাদিকদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন ইউক্রেনের সাংবাদিক ওলেক্সান্দ্রা গুবিৎস্কা। তিনি বলেছেন, নারী ও পুরুষ সাংবাদিক—সবার জন্য বর্তমান সময় সমান কঠিন। নতুন সাংবাদিকদের সব সময় কৌতূহলী ও সক্রিয় থাকতে হবে। লেগে থাকতে হবে। দায়িত্ব নিতে ও সত্যের সন্ধান করতে কখনো ভীত হওয়া যাবে না।

ভারতের পুরস্কারজয়ী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সৃষ্টি জাসওয়াল বলেন, ‘ভারতের গ্রেপ্তারের ভয়, আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা এবং হাজারো ধর্ষণ ও মৃত্যুহুমকি সত্ত্বেও আমি উন্মোচন করেছিলাম “হিন্দু আইটি সেল” নামে একটি ট্রোল ফার্মের কর্মকাণ্ড, যারা ভারতের হিন্দু ডানপন্থীদের সমর্থন পায়। তারা আমাকে হেনস্তা-হয়রানির মাধ্যমে চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি সাংবাদিকতা দিয়ে তাদের উন্মোচন করেছি।’

আট নারী সাংবাদিকের মধ্যে আরও রয়েছেন কলম্বিয়ার ডায়ানা সালিনাস প্লাজা, মালয়েশিয়ার মাহি রামাকৃষ্ণান, মেক্সিকোর কেনিয়া ভেলাজকেজ, বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) মার্থা মেনডোজা ও নাইজেরিয়ার জাস্টিনা আশিশানা।

এই সাংবাদিকদের মধ্যে কেনিয়া ভেলাজকেজ নারী সাংবাদিকদের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি অন্য সাংবাদিকদের আরও নিয়মনিষ্ঠ ও যথার্থ হওয়ার পরামর্শ দেব। একই সঙ্গে বলব আরও বেশি বেশি অনুসন্ধান পড়তে এবং অন্য নারী সাংবাদিকদের অনুসরণ করতে। এভাবে আপনি ক্রমাগত নতুন নতুন আইডিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন।’