চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা দূর করতে খরচ ৫৭৯০ কোটি টাকা, এরপরও সুফল নেই

১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। আগামী জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।

পানিতে ডুবে গেছে বাড়ির উঠান ও সড়ক। তাই রিকশায় চড়ে বাড়িতে প্রবেশ করছেন চট্টগ্রাম সিটির মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। গতকাল দুপুরে বহদ্দারহাটে
ছবি : সংগৃহীত

গত ছয় বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা খরচ হলেও চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন তো হয়নি; বরং প্রকট হয়েছে। এখন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আবার বেশি সময় ধরে পানি জমে থাকছে। ভারী বৃষ্টিতে বছরে অন্তত ৮ থেকে ১০ বার ডুবছে নগর।

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের পুরোনো সমস্যা। এ সমস্যা নিরসন না হওয়ার জন্য একসময় অর্থ বরাদ্দকে অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হতো। কিন্তু এখন সে সমস্যা নেই। বিপুল টাকা খরচ হলেও নগরবাসী সুফল পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন ও সিডিএ পরস্পরকে দায়ী করছে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার ও গতকাল শনিবার দুই দফায় অন্তত ৫০টি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে ছিল ৯–১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। এমনকি সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বহদ্দারহাটের বাড়ির উঠান ও সামনের রাস্তাও ডুবে যায়। শুক্রবারের মতো গতকালও রিকশা চড়ে ঘরে ঢুকতে হয়েছে মেয়রকে। জলাবদ্ধ এলাকাগুলোতে অনেকে দোকানপাটও খুলতে পারেননি।

সিডিএ খালগুলো থেকে দৃশ্যত বাঁধ অপসারণ করলেও মাটি রয়ে গেছে। তাতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা জলকপাটগুলোর কাজও শেষ করতে পারেনি।
রফিকুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

এত ব্যয় তবু সুফল নেই

জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। গত ছয় বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরেও সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। আগামী বছরের জুনে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।

নগরের বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত নতুন খাল খননে ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। ২০১৪ সালের জুনে অনুমোদন হলেও এই প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি।

জলাবদ্ধতা দূর করতে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছিল সিডিএ। ২০১৭ সালের আগস্টে এর অনুমোদন দেওয়া হয় একনেকে। কাজ শুরু হয় পরের বছরে। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এই টাকায় ৩৬টি খালের ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে, নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিরোধ দেয়াল, নতুন নালা, সেতু ও কালভার্ট। এ ছাড়া পাঁচটি জলকপাট চালু করা হয়েছে।

সিটি করপোরেশন ঠিকমতো নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার করছে না। নতুন খালটি খনন করতে পারেনি। এ কারণে নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
কাজী হাসান বিন শামস, প্রধান প্রকৌশলী, সিডিএ

কর্ণফুলী নদীর পাশে বাঁধসহ রাস্তা নির্মাণে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনে এই প্রকল্পের আওতায় নদীর সঙ্গে যুক্ত ১২টি খালের মুখে জলকপাট নির্মাণ করার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ১০টির অবকাঠামো শেষ করতে পারলেও সেগুলো চালু হয়নি। এর মধ্যে নগরের পানিনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম চাক্তাই ও রাজাখালী খাল রয়েছে। জলকপাটগুলো চালু না হওয়ায় বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নগরের জলাবদ্ধতা তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড নগরের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত নগরের ২৩ খালের মুখে জলকপাটের কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯৭ কোটি টাকা।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা সমস্যা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হওয়ার জন্য সিটি করপোরেশন ও সিডিএ পরস্পরকে দায়ী করছে। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা কেন নিরসন হচ্ছে না, এটি ভালো বলতে পারবে সিডিএ। সিডিএ খালগুলো থেকে দৃশ্যত বাঁধ অপসারণ করলেও এখনো মাটি রয়ে গেছে। তাতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা জলকপাটগুলোর কাজও শেষ করতে পারেনি।

তবে সিটি করপোরেশনের দাবি মানতে রাজি নন সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও প্রকল্প পরিচালক মো. শাহ আলী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁরা খাল থেকে সব বাঁধ সরিয়ে নিয়েছেন; বরং সিটি করপোরেশন অনেক জায়গায় নালা–নর্দমা ও খালে বাঁধ দিয়ে কাজ করছে। আর জোয়ারজনিত জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি তাঁদের হাতে নেই। এ ব্যাপারে সিডিএ আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

আরও পড়ুন

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, সিটি করপোরেশন ঠিকমতো নালা–নর্দমাগুলো পরিষ্কার করছে না। নতুন খালটি খনন করতে পারেনি। এ কারণে নগরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ফলে জলাবদ্ধতা বেশি হচ্ছে। তবে সব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মানুষ সুফল পাবে।

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার মনে করেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে চারটি প্রকল্পের কাজ চললেও প্রাধিকার ভিত্তিতে কাজগুলো করা হয়নি। অনেক খালে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ ও পরিষ্কারের কাজ শেষ হলেও খালগুলোর মুখে জলকপাট চালু হয়নি।

আবার সংস্থাগুলো যে যার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। এর খেসারত দিচ্ছেন নগরবাসীকে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তদারকির দায়িত্ব নিতে হবে। প্রকল্পগুলোর ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা চিহ্নিত করে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান করতে হবে।

আরও পড়ুন