ফিরে চল্‌ মাটির টানে

অদিতি মহসিন

একুশ বা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের শুধু নয়, পুরো বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের। সময়ের ব্যবধান যতই হোক, এ গৌরব বয়ে নিয়ে যাওয়া জাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্য। বাংলা ভাষার জন্য আমাদের পিতৃপুরুষের যে আত্মবলিদান, তা তো বৃথা হয়নি, সে জন্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটি স্বীকৃতি পেয়েছে।

এখন ভাবার বিষয় হলো, আজকের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার প্রতি যথাযথ চর্চা বা যত্ন আমরা করছি কি না। সেই চর্চার বিষয়টি কিন্তু এক দিনের একুশের উদ্‌যাপন বা একটি বইমেলা দিয়ে সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়; বরং এ জন্য অনেক গভীর থেকে কাজ করতে হয়। অর্থাৎ একটি শিশুর জীবন ও মননে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি তথা গান ও কবিতাকে যদি আমরা গেঁথে দিতে পারি, তবেই একুশের চেতনার দীপশিখা আমরা যথাযথভাবে জ্বালিয়ে রাখতে পারব। বিষয়টি কেবল সংগীতশিল্পী হিসেবে নয়, একজন মা হিসেবেও আমার মনে হয়।

বলা বাহুল্য, এ কাজের শুরু হতে হবে পরিবার থেকে। একটি প্রজন্মের যেকোনো ধরনের শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু হয়। তারপর বিদ্যালয় তথা শিক্ষাব্যবস্থাতেও যত্নের সঙ্গে বাংলার চর্চা বাড়ানো দরকার। এই পরম্পরায় সমাজের মধ্যে যদি ভাষার ব্যবহার প্রসারিত করা যায়, নিঃসন্দেহে তার প্রভাব গোটা জাতির ওপর পড়বে। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখতে পাই, আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি—একধরনের মিশেল ভাষায় কথা বলে, কারও কারও আবার বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের লেখা পড়ার ব্যাপারে অনাগ্রহও রয়েছে। আমি মনে করি, এসব ঘটনায় পরিবারের ভূমিকা নেওয়ার অবকাশ থাকে। একুশের চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া বলতে প্রথমত আমি এগুলোকেই বুঝে থাকি।

শুধু তো বায়ান্ন নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ও রয়েছে আমাদের। আর এসব অধ্যায়ের সঙ্গে মিশে আছে বাংলা গান, কবিতাসহ আরও অনেক কিছু। তবে যুগের হাওয়ায় সেসব গান কি আমরা হারিয়ে ফেলছি? সেই গানগুলোর প্রতি আমরা কি যথেষ্ট যত্নবান হতে পারছি?—ভাষার এই মাসে প্রশ্নগুলো আমাকে তাড়া করে ফেরে।

আমরা বলি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনার বাতিঘর। এই চেতনা আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাছ থেকে, ভাষাসংগ্রামী আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, আজকাল এমন কথাও শুনতে পাই যে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্র-নজরুলের গান আর সেভাবে শোনে না! ঘটনাটি আদতেই কি তাই? এ ব্যাপারে পরিবার থেকেই নজর দেওয়া প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মকে শিকড়ের মর্মমূলে ফিরিয়ে নেওয়ার বা ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনেই একুশের চেতনার কাছে আমাদের ফিরতে হয়, ‘ফিরে চল্‌, ফিরে চল্‌, ফিরে চল্‌ মাটির টানে—/ যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে॥’ ঠিক এভাবেই তো আমরা ফিরি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কাছে।

আমি যখন রবীন্দ্রসংগীত গলায় ধারণ করি, গেয়ে উঠি, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে...’, তখন কিন্তু প্রকারান্তরে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বা মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ চেতনার কথাই মনে পড়ে আমার। আমরা যে আজ বাংলা ভাষায় গান গাইছি, কবিতা পড়ছি অথবা আমি যে আজ শিল্পী হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছি, এর নেপথ্যে শক্তির আধার হয়ে আছে একুশে ফেব্রুয়ারি। সব মিলিয়ে বলতে পারি, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শুধু বাঙালি হিসেবেই প্রতিষ্ঠা দেয়নি, মানুষ হিসেবেও বিশ্ব-মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো করছে।

অদিতি মহসিন: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী