অস্থিরতা, রাগ, অপরাধ সবই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, কারণ কী

মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। এই অস্থিরতা বিভিন্ন অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। ঘটনা খুন পর্যন্তও গড়াচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের পোস্টে ‘হা হা’ দিয়ে হাসলি কেন? বিয়ের ভোজে পাতে মাংস এত কম কেন? রেস্তোরাঁয় বেগুনি কম ভাজা হয়েছে কেন? তুই আমাকে গালি দিলি কেন? এই চেয়ারে তুই বসলি কেন?

সুকুমার রায়ের ‘নারদ! নারদ!’ কবিতার আদলে এমন সব প্রশ্নে ইদানীং রেগেমেগে বাস্তবিকই তুলকালাম কাণ্ড ঘটাচ্ছে মানুষজন—এমনকি শিশুরাও।

অপরাধতত্ত্ববিদ আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। এই অস্থিরতা বিভিন্ন অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। ঘটনা খুন পর্যন্তও গড়াচ্ছে।

মানুষের মধ্যে এখন আর কোনো স্থিরতা নেই। প্রেম, টাকাপয়সা—কোনো কিছুর জন্যই কেউ সময় দিতে রাজি নয়।
আনোয়ারা সৈয়দ হক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

মে মাসের প্রথম সপ্তাহের তাপপ্রবাহে মানুষ যখন নজিরবিহীন গরমে অস্থির, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক রিকশা আরেক রিকশাকে একটু ধাক্কা দিয়েছে। ব্যস! দুই চালকের মধ্যে কান গরম করা গালাগালি থেকে হাতাহাতি শুরু হলো। পাশের গাড়ির চালক মাথা বের করে বললেন, ‘অ্যাই, ওরে ধরে মার!’

পেছনের রিকশা থেকে এই প্রতিবেদক আরও দেখলেন, আরেকটি গাড়ি থেকে সুবেশ এক প্রবীণ নেমে চড় মারতে হাত তুলে গজগজ করতে করতে ছুটেছেন মারমুখী রিকশাচালকদের দিকে। ততক্ষণে চারপাশে জট লেগে গেছে, গাড়িগুলো তারস্বরে একটানা হর্ন বাজিয়ে চলেছে।

গালাগালের বিচার গিয়ে উঠেছে হাইকোর্টেও। একটি সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কায়সার খসরু স্থানীয় এক সাংবাদিককে কষে গালিগালাজ করেন।

বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন একজন আইনজীবী। আমলে নিয়ে হাইকোর্ট বলেন, ইউএনওর ভাষা ছিল খুবই আপত্তিজনক ও দুঃখজনক—তিনি একজন মাস্তানের চেয়েও খারাপ ভাষা ব্যবহার করেছেন। ২০২২ সালের ২৪ জুলাই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছিল।

ওই দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবের ফল নিজ চোখে দেখলাম। তারা কাউকে মানছিল না।
পুলিশ সদস্য ভৈরব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহাবুব উল্লাহ সরকার

প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরের শিরোনামে ‘তুচ্ছ কারণ’ শব্দটি যোগ হচ্ছে। প্রতিবেদনগুলো দেখায়, আপাতদৃষ্টে ছোট্ট ঘটনার জের ধরে ভয়াবহ সহিংস প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। একজন অপরাধবিজ্ঞানী ও একাধিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলছেন, মানুষ দ্রুত রেগে যাচ্ছে।

তাঁরা আরও বলছেন, অন্যদিকে আবার মানুষ এমন ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে বিচলিত হচ্ছে, প্রতিবাদ করছে; তবে দ্রুত ভুলেও যাচ্ছে। মানুষ নির্বিকার হয়ে যাচ্ছে।

অথবা এই নির্বিকারত্ব মানুষের মস্তিষ্কের সহজাত প্রবণতা। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের শিক্ষক স্নায়ুবিজ্ঞানী তালি শ্যারো এবং হার্ভার্ডের আইনবিষয়ক অধ্যাপক কাস আর সানসটেইন গত ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্ক টাইমস–এ একটি নিবন্ধ লেখেন। এর শিরোনাম ছিল, ‘মানুষ কেন তার চারপাশের আতঙ্ক বা বীভৎসতা দেখতে পায় না।’

লেখক দুজন বলেছেন, অভ্যস্ততা মানুষের মৌলিক জৈবিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ জটিল সামাজিক পরিস্থিতি যেমন যুদ্ধ, দুর্নীতি, বৈষম্য, নির্যাতন, সর্বব্যাপী অপতথ্য এবং চরমপন্থায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সব সময় ঘটতে দেখা ঘটনা কিংবা খুব ধীরগতির পরিবর্তনের ব্যাপারে মস্তিষ্ক নিঃসাড় থাকে।

স্কুলে ভালো ফল করতেই হবে—অভিভাবকদের এ তাড়নায় শিশুরা অস্থির থাকছে। রাতজাগা বা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের মতো জীবনযাপনগত কারণেও মানুষের মধ্যে রেগে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

মানুষের রাগ-ক্ষোভ কেন এত বাড়ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, নৈতিক শিক্ষার অভাব, সম্পর্কে টানাপোড়েন, হতাশা, অপ্রাপ্তি, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, মানুষের রোজনামচায় পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে, গবেষণাও হয়েছে। তবে ঠিকঠাক উত্তর মেলেনি।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানালেন, তাঁদের কাছে অনেক কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ আসছে হঠাৎ খেপে যাওয়া এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার সমস্যা নিয়ে।

ডা. হেলালের মতে, ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করা বা স্বীকৃতি আদায়ে মানুষ মরিয়া হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে ভালো ফল করতেই হবে—অভিভাবকদের এ তাড়নায় শিশুরা অস্থির থাকছে। রাতজাগা বা অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের মতো জীবনযাপনগত কারণেও মানুষের মধ্যে রেগে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।

গত এপ্রিলের প্রথম ভাগে ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখ মিলিয়ে ছয় দিনের ছুটি ছিল। ছুটির মধ্যে পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ সহায়তা চেয়ে ফোন এসেছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। এর এক-চতুর্থাংশের বেশি ছিল মারামারির কারণে।

অস্থিরতার উসকানিতে যত অপরাধ

একনজরে প্রথম আলোয় এ বছর প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন দেখা যাক।

‘ফেসবুক পোস্টে হা হা নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৮’—খবরটি গত ৪ এপ্রিল প্রকাশিত হয়। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের কমলপুরে মধ্যপাড়ার তরুণ ওমর মিয়ার একটি ফেসবুক পোস্টে ‘হা হা’ হাসির প্রতিক্রিয়া দেন পূর্বপাড়ার আজিবর মিয়া। এতে খেপে ওঠেন ওমর। দুই পক্ষ দা-বল্লম নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। খবর পেয়ে র‍্যাব ও পুলিশ আসে, কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হন। পুলিশ মামলা করে।

মামলার বাদী আহত পুলিশ সদস্য ভৈরব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাহাবুব উল্লাহ সরকার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ওই দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবের ফল নিজ চোখে দেখলাম। তারা কাউকে মানছিল না।’

১৮ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর, ‘চেয়ারে বসা নিয়ে কলহ, কিশোরের লাথিতে আরেক কিশোর নিহত’। ঘটনাটি ঘটেছিল ময়মনসিংহের গৌরীপুরে।

২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম কলেজে জ্যেষ্ঠ নেতাকে সালাম না দেওয়ায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষ রড নিয়ে একে অন্যের ওপর চড়াও হয়। আহত হন পাঁচজন। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

ওদিকে প্রথম আলোয় ১৮ মার্চের একটি প্রতিবেদন বলছে, ময়মনসিংহের ত্রিশালে রেস্তোরাঁয় বেগুনি ভালো করে ভাজা হয়নি—এ নিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও দোকানদারের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। এর জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকা ও ক্যাম্পাসে কয়েক দফায় হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

কিছু কিছু ঘটনা নিয়ে অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রতিবেদন বেরিয়েছে, বিভিন্ন পক্ষের বয়ান ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। যেমন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এমন একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বৃদ্ধা সুফিয়া খাতুন স্বামীর জন্য ডাক্তার ডাকতে গেলে একপর্যায়ে স্বাস্থ্য সহকারী ফরহাদ হোসেন তাঁকে মোবাইল ফোন দিয়ে আঘাত করেন এবং ঘাড়ধাক্কা দেন।

টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, চারপাশের প্রতিকূলতার কারণে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করে। এমন প্রতিকূলতার মধ্যে আছে বৈষম্য, প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব, পরিবার-সমাজ-রাজনীতিতে নানা বিচ্যুতি ও অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং জিনিসপত্রের দাম বাড়া।

অধ্যাপক উমর বলেন, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। তাদের আগ্রাসী মনোভাব বা অস্থিরতা বাড়ছে। তারা অল্পতেই সহিংস হচ্ছে। এ ছাড়া ২০২২ সালে একটি গবেষণায় তিনি দেখেছেন, মার্চ থেকে আগস্ট মাসে গরম ও খরার সময় সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যায়।

২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর প্রথম আলোয় ‘গরমকালে অপরাধ বাড়ে কেন?’ শিরোনামের এক খবরে পুলিশ সদর দপ্তরের চার বছরের মামলার সংখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। প্রতিবেদনটি বলছে, বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ গরমকালে দেশে হত্যা, চুরি, ডাকাতি, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ এবং মামলা বাড়ে।

অস্থিরতা ও হতাশার জের

‘একসঙ্গে তিনজনের মৃত্যুতে গ্রামজুড়ে আতঙ্ক আর শোক’—এই ছিল প্রতিবেদনটির শিরোনাম। এটি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল গত ১০ মে। ঘটনাস্থল হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আগুয়া গ্রাম। অটোরিকশায় যাত্রী ওঠানো নিয়ে চালক কাদির মিয়ার সঙ্গে স্ট্যান্ডের তত্ত্বাবধায়ক বদরুল আলমের কথা-কাটাকাটি হয়।

এ খবর আগুয়া গ্রামে পৌঁছালে দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজন লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সংঘর্ষ চলে প্রায় ৪০ মিনিট। প্রতিপক্ষের বল্লমের আঘাতে তিনজন প্রাণ হারান।

প্রথম আলোতেই ৮ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। রাজধানীর বাসিন্দা মশিউর রহমান নিজের ছেলে ও মেয়ের শ্বাস রোধ করার পর নিজে আত্মহত্যা করেন। তবে মেয়েটি বেঁচে যায়। মশিউর একটি আবাসনপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তিন বছর আগে তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিল।

প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ৪ মার্চ সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী আরাফাত আমিনের পায়ে গুলি করেন। কারণ, তাঁর অসময়ে ডাকা ক্লাসে আরাফাত হাজির হননি।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত ৭৯টি খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য বলছে, গত তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) আপাতদৃষ্টে ছোটখাটো ঘটনার পর বা সূত্র ধরে অন্তত ১৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে ২৮ এপ্রিল একটি প্রতিবেদনও বেরোয়।

অ-সুখ বাড়ছে

মানসিক স্বাস্থ্য, সুখী দেশের তালিকা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই) প্রতিবেদন-২০২৩ বলছে, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তালিকায় গত বছর বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ, আর ঢাকা ছিল শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জাতীয় জরিপ (২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল) বলছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১৩ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে।

গত ৪ এপ্রিল প্রথম আলোর ‘মতামত’ পাতায় ‘উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন সুখহীনতায়’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের একটি কলাম প্রকাশিত হয়। তিনি লিখেছেন, ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের বিশ্ব সুখ জরিপে বাংলাদেশ হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ। জরিপটিতে সুখের প্রধান মাপকাঠিগুলো ছিল ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি-সম্পর্ক, সুস্বাস্থ্য ও পেশাগত বা চাকরিতে সন্তুষ্টি।

অধ্যাপক মঈনুল লিখছেন, জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত এ বছরের বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন বা ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ১৪৩টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ আছে শেষের কাতারে—১২৯তম অবস্থানে। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১১৮।

প্রতিবেদনটি সুখ সম্পর্কে ব্যক্তির নিজস্ব মূল্যায়ন নম্বর দিয়ে এই অবস্থান মাপে। পাশাপাশি ছয়টি চলক বা বিষয়ে উপাত্তের সঙ্গে এই মূল্যায়নকে মিলিয়ে দেখা হয়। চলকগুলো হচ্ছে মাথাপিছু জিডিপি, সামাজিক সহায়তা, প্রত্যাশিত সুস্থ আয়ু, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, উদারতা ও দুর্নীতি।

সাত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষ সুখী দেশ হচ্ছে ফিনল্যান্ড। অধ্যাপক মঈনুল লিখছেন, ফিনল্যান্ডে মানুষের সুখী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন, সুখ নিয়ে বেশি চিন্তা না করা, হতাশাবাদী না হওয়া, আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা বা বহিঃপ্রকাশ না করে অনাড়ম্বর বা সাদামাটা জীবন যাপন করা।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের অস্থিরতা, রাগ-ক্ষোভের প্রভাব পড়ছে তার কর্মক্ষেত্রে। ফলে উৎপাদনক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তাই বিষয়গুলো অবহেলা করার উপায় নেই। তাঁর পরামর্শ হলো, প্রয়োজনে যথাযথ কাউন্সেলিং বা পরামর্শসেবা এবং চিকিৎসা নিতে হবে।

গত এপ্রিলের প্রথম ভাগে ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখ মিলিয়ে ছয় দিনের ছুটি ছিল। ছুটির মধ্যে পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ সহায়তা চেয়ে ফোন এসেছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। এর এক-চতুর্থাংশের বেশি ছিল মারামারির কারণে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বললেন, মানুষের মধ্যে এখন আর কোনো স্থিরতা নেই। প্রেম, টাকাপয়সা—কোনো কিছুর জন্যই কেউ সময় দিতে রাজি নয়। বিয়ের কয়েক দিনের মাথায় দুম করে তালাক হয়ে যাচ্ছে। মোবাইল দরকার, তো এখনই লাগবে। খুব সহজে মানুষ আত্মহত্যা করে ফেলছে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আনোয়ারা আরও বললেন, দেশের এ অবস্থা তো একদিনে হয়নি। এখন ছেলেমেয়েদের মূল লক্ষ্য বড় অফিসার হবে, দামি গাড়ি কিনবে। তিনি বলেন, ‘তাদের সেই পরিবার, পরিবেশ কিছুই তো আমরা দিতে পারছি না।’