গাড়ি নেই, তবে দেড় বছর ধরে নেন জ্বালানি খরচ

যে গাড়ি নিজের নামে বরাদ্দ নয়, সেই গাড়ির জন্য দেড় বছর ধরে জ্বালানি খরচ নিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু সাঈদ।

ফাইল ছবি

যে গাড়ি নিজের নামে বরাদ্দ নয়, সেই গাড়ির জন্য দেড় বছর ধরে জ্বালানি খরচ নিয়েছেন ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু সাঈদ। গাড়িটি বরাদ্দ আরেক উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জাকির হোসেন প্রধানীয়ার নামে। তিনিও গাড়ির পরিচালনা খরচ পেয়েছেন।

এ ঘটনা জেনেও আবু সাঈদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সংস্থাটির মিডিয়া সেলের সদস্যের দায়িত্ব দিয়েছে বলে জানা গেছে।

আবু সাঈদ বর্তমানে ওয়াসার রাজস্ব অঞ্চল-১–এ কর্মরত। গত ২ জানুয়ারি তাঁকে অঞ্চল-৩ থেকে বদলি করা হয়। আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটে তিনি অঞ্চল-৩–এ থাকার সময়।

আবু সাঈদের বেতনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে গাড়ি ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে জ্বালানির জন্য ১৫ হাজার টাকা নেওয়া শুরু করেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১৭ মাস জ্বালানির এ টাকা নিয়েছেন। একই বছরের শেষ দিকে এসে বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় আবু সাঈদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ গত জানুয়ারি মাসে তাঁর বেতন থেকে ১৫ হাজার টাকা কেটে রাখে।

ওয়াসার হিসাবরক্ষণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়ি না থাকলেও উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার জ্বালানি খরচ নেওয়ার বিষয়টি হিসাব বিভাগ প্রথম ধরতে পারে। পরবর্তী মাসে তাঁর বেতন থেকে জ্বালানির টাকা কেটে রাখা হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

এ ঘটনার পাশাপাশি আবু সাঈদ আরেকটি গাড়ি ভাড়াও নিয়েছেন। অঞ্চল-৩–এর উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার জন্য গাড়িটি রেন্ট-এ–কার থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। সাঈদের ব্যবহার করা সেই গাড়ির ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ৮৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ বরাদ্দহীন একটি গাড়ির জ্বালানি খরচ গ্রহণ ও ব্যবহারকৃত একটি গাড়ির ভাড়া তুলেছেন তিনি।

* ২০২১ সালের আগস্ট থেকে গাড়ি ব্যবহার বাবদ প্রতি মাসে জ্বালানির জন্য ১৫ হাজার টাকা নেওয়া শুরু করেন তিনি। * গত বছরের শেষ দিকে এসে বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার মিডিয়াকে দেওয়ার মতো কোনো বক্তব্য নেই। যা বলার ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে বলেছি। জনসংযোগ বিভাগ থেকে বক্তব্য জেনে নিন।’

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের জন্য ১৪ সদস্যের একটি মিডিয়া সেল গঠন করেছে ঢাকা ওয়াসা। এই সেলে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা রয়েছেন। সেলে উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা সাঈদকেও রাখা হয়েছে। এই সেলের আহ্বায়ক সংস্থাটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ)।

ঢাকা ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বারবার বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। কিন্তু সংস্থার একজন কর্মকর্তা এমন আর্থিক অনিয়ম করার পরও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো তাঁকে মিডিয়া সেলের সদস্য করে পুরস্কৃত করেছে।

আবু সাঈদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ জানিয়ে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি দেন সংস্থাটির রাজস্ব অঞ্চল-৩–এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে এলাকা বণ্টনের জন্য বিলিং সহকারীদের কাছ থেকে তিন–চার লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আছে। অভিযোগ আছে, সাঈদ সেবা নিতে আসা গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অধীনস্থ কর্মীদের গালাগাল করেন। দাবি জানানো হয়—সাঈদের কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর।

জ্বালানি খরচ নেওয়ার বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সাঈদের বিরুদ্ধে আগের অভিযোগটিতে কোনো ব্যক্তির স্বাক্ষর ছিল না। তাই আমলে নেওয়া যায়নি।
এ এম মোস্তফা তারেক, উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা, ঢাকা ওয়াসা

এসব অভিযোগের বিষয়েও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঢাকা ওয়াসা। জানতে চাইলে সংস্থার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্বালানি খরচ নেওয়ার বিষয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সাঈদের বিরুদ্ধে আগের অভিযোগটিতে কোনো ব্যক্তির স্বাক্ষর ছিল না। তাই আমলে নেওয়া যায়নি।’

যে গাড়ির বিপরীতে আবু সাঈদ জ্বালানির টাকা নিয়েছেন, সেটি ২০২২ সালের ২৫ মে এক অফিস আদেশে অঞ্চল-৮–এর উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা জাকির হোসেন প্রধানীয়া গাড়িটি ব্যবহার করছেন। নিয়মিত পরিচালন খরচও পেয়েছেন। সাঈদের বিরুদ্ধে এই গাড়ি বাবদ জ্বালানি খরচ নেওয়ার বিষয়ে জাকির হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা ওয়াসার একটি শুদ্ধি অভিযান কমিটি রয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক। আর সদস্যসচিব মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রধানীয়া। ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তার দাবি, জ্বালানি বাবদ আবু সাঈদের টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতেন জাকির হোসেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানাননি। শুদ্ধি কমিটির সদস্যসচিবেরই এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কয়েকজন কর্মকর্তা।

জ্বালানি সুবিধা আরও বেড়েছে

ডিজেল ও অকটেনের দাম বাড়ায় গত ২৭ ডিসেম্বর ওয়াসার কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহৃত গাড়ির মাসিক জ্বালানি ভাতা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। নতুন ভাতা অনুযায়ী, জিপ গাড়ির জন্য একজন কর্মকর্তা মাসে ২৫০ লিটার ডিজেল বা ২৭ হাজার ২৫০ টাকা পাচ্ছেন। আগে ছিল ২২ হাজার টাকা। ডাবল কেবিন পিকআপের জন্য পাচ্ছেন ২০০ লিটার বা ২১ হাজার ৮০০ টাকা। আগে যা ছিল ১৮ হাজার টাকা। আর অকটেনচালিত গাড়ির জন্য ১৫০ লিটার অকটেন বা ১৯ হাজার ৫০০ টাকা পাচ্ছেন। এ ছাড়া সিএনজিচালিত গাড়ির জন্য ১৫ হাজার টাকা জ্বালানি খরচ ধরা হয়েছে।