‘খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে বললেন, এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাব না’

সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের একজন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর রাজনীতিতে এসেছিলেন খালেদা জিয়া। তারপর শুরু করেন এরশাদবিরোধী আন্দোলন। সেই সময়ের কথা লিখেছিলেন এম সাইফুর রহমান। তাঁর আত্মজীবনী ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ থেকে সেই অংশটুকু এখানে প্রকাশ করা হলো।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াছবি: এএফপি

জিয়া নিহত হওয়ার পর জাস্টিস সাত্তার সাহেব প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেন। এরপর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। সেইভাবে প্রস্তুতি নিতে হলো। ওই প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আমাদের মধ্যে একদল বেগম খালেদা জিয়াকেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে সমর্থন করলাম। তাঁকেই আমরা মনোনয়ন দিতে চাইলাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে একদল বিচারপতি সাত্তারকে সমর্থন করলেন এবং তাঁকে মনোনয়ন দিতে চাইলেন।

আমার ধারণা হয়, বিচারপতি সাত্তারকে মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারে জেনারেল এরশাদের প্ররোচনা ছিল। কারণ, বেগম জিয়া প্রেসিডেন্ট হলে তিনি শক্ত হাতে সবকিছু দেখতেন—এমন আশঙ্কায় জেনারেল এরশাদ ওই রকম প্ররোচনা দেন। এ নিয়ে আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। জনাব তানভির আহমদ সিদ্দিকী, আমি এবং আরও অনেকে বেগম জিয়ার মনোনয়নের পক্ষে ছিলাম। কিন্তু নানাভাবে এবং পরোক্ষভাবে আমাদের ইঙ্গিত দেওয়া হয়—এ নিয়ে আপনারা বাড়াবাড়ি করবেন না। বিষয়টা প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। সেই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ডা. এম এ মতিন। তিনি বিচারপতি সাত্তারের মনোনয়নের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিচারপতি সাত্তারের পক্ষে একটা প্রেশার গ্রুপ সৃষ্টি করা হয়। ফলে অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বিচারপতি সাত্তারকেই সমর্থন করেন।

সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান
ফাইল ছবি

আমি ভালোভাবেই জানতাম, বিচারপতি সাত্তার খুব দুর্বল লোক ছিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম না, কেন তারা বেগম জিয়াকে সমর্থন না করে সাত্তার সাহেবকে সমর্থন করছে। পরে বুঝলাম, সাত্তার সাহেব খুব দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন বলে তারা তাঁকে সমর্থন করে। বেগম জিয়ার নামে মনোনয়ন দাখিল করা হলেও তা প্রত্যাহার করানো হয়। প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ বিচারপতি সাত্তারের পক্ষে মনোনয়ন দিতে আগ্রহী ছিলেন। সেই সময় লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ছিলেন জনাব শামসুদ্দোহা। ওই সময় তিনি ঢাকা আসেন। একদিন তিনি আমাকে টেলিফোন করে বলেন, আপনারা প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন নিয়ে মতভেদ করছেন কেন। সম্ভবত তিনি এরশাদের প্ররোচনায় সাত্তার সাহেবের পক্ষে ছিলেন। মনোনয়ন নিয়ে আমার ভূমিকায় জেনারেল এরশাদ খুশি ছিলেন না? সম্ভবত সে কারণে সামরিক আইন জারির পরপরই প্রথমে আমাকে ও তানভীর আহমদ সিদ্দিকীকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয়।

বিচারপতি সাত্তারকে মনোনয়ন দেওয়ার পর আমি তাঁর পক্ষে কাজ করি। সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর পক্ষে জনমত গঠনে আমি সচেষ্ট হই। নির্বাচনে বিচারপতি সাভার জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি তাঁর ক্যাবিনেটে আমাকে অর্থমন্ত্রী হিসেবেই রাখলেন।

বিচারপতি সাত্তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর জেনারেল এরশাদ দেশের অবস্থা সম্পর্কে নানা রকম বিবৃতি দিতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন, প্রশাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্ব থাকতে হবে। তাঁর ওই সব বক্তব্য ছিল অগণতান্ত্রিক। তাঁর বক্তব্য দেশে-বিদেশে নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন জনাব এম সাইদুজ্জামান। তিনি ওয়াশিংটন থেকে আমাকে জানান, জেনারেল এরশাদের বক্তব্যে এখানে বেশ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল। নির্বাচন হয়েছে এবং ধারণা করা হয়েছিল যে দেশটিতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। কিন্তু প্রশাসনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জেনারেল এরশাদের বক্তব্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা নিয়ে অনেকে এখানে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো ছিল। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে তারা যদি অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেয়, তা দেশের জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করবে। জনাব সাইদুজ্জামান সব বিষয় জানিয়ে আমাকে ফ্যাক্স করেন। আমি ওই ফ্যাক্সটা নিয়ে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সাত্তার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। আমি বললাম, স্যার, এরশাদ সাহেবের বক্তব্যে নানা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে। এমতাবস্থায় তারা যদি এইড বন্ধ করে বা কমিয়ে দেয়, তাহলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্য সংকট সৃষ্টি করবে। বিষয়টা আপনাকে জানানো দরকার, তাই জানালাম।

১৯৯০ সালের অক্টোবরে রাজধানীর গুলিস্তানে বিএনপির সমাবেশে খালেদা জিয়া
ছবি: মো. লুৎফর রহমান বীনু, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম’ বই থেকে

এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শুরু

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা নিলেন (১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ)। ক্ষমতায় এসে উনি আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরলেন। আট-নয় মাস আমাকে জেলে রাখলেন।

জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়। বেগম জিয়াকে নিয়ে আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সফর করি। আসলে আমরাই খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। কারণ, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার পর বিএনপি দলে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান বিচারপতি সাত্তারের দিকে সমর্থন অব্যাহত রাখেন। সত্যি কথা বলতে কি, সে সময় বিএনপি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে কিছু কথা কিছু স্মৃতি থেকে যায়। শাহ আজিজের সাথে অনেকে যোগ দেয়। ডা. এম এ মতিন, জনাব শামসুল হুদা চৌধুরী ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে শাহ আজিজ আর একটা বিএনপি দল গঠন করেন। ওই দল বিএনপি (হুদা-মতিন) নামে পরিচিত হয় ১৯৮৩ সালের ৩ এপ্রিল থেকে। কিন্তু আমরা ওই দলকে সমর্থন করতে পারিনি। আমরা বেগম জিয়াকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করি। বেগম জিয়া অবশ্য রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিলেন। আমরা তখন তাঁকে উদ্বুদ্ধ করি। আমি, তানভীর আহমদ সিদ্দিকী, ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মীর্জা গোলাম হাফিজ, মোস্তাফিজুর রহমান, ওবায়দুর রহমান, মাজেদুল হক, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, আবদুল মতিন চৌধুরী এবং আরও অনেকে আমাদের সাথে ছিলেন। এ সময় বিএনপিতে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা চলছিল। আসলে জেনারেল এরশাদ এমন একটা বিএনপি দাঁড় করাতে চান, যাতে তারা তাঁকে সমর্থন দেয়। ফলে বিএনপি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। পরে এরশাদ জাতীয় পার্টি করলে বিএনপির ওই গ্রুপের প্রায় সবাই জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ছিল তিন জোটের ঢাকা অবরোধ। তার পরদিন রাজধানীর হোটেল পূর্বাণী থেকে খালেদা জিয়াকে আটক করে পুলিশ।
ছবি: মো. লুৎফর রহমান বীনু, ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম’ বই থেকে

বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলন নতুন রূপ লাভ করে। বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। বিএনপির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সাতদলীয় জোট, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পনেরো দলীয় জোট। এরশাদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে দুই জোটই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু হঠাৎ করে শেখ হাসিনা (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী) নির্বাচনে (১৯৮৬) অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। অথচ নির্বাচনে যোগদান না করার ঘোষণা করে চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে তিনি এক জনসভায় বলেন, যারা নির্বাচনে যাবে, তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে গণ্য করা হবে। ওই বক্তব্য দেওয়ার এক দিন পর তিনি ঢাকায় ঘোষণা করেন যে, তাঁর দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এই ঘোষণা করে শেখ হাসিনা এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করে দেন। আসলে শেখ হাসিনা সব সময় এরশাদকে সমর্থন করেন এবং সে কারণে এরশাদ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন। শেখ হাসিনা যদি মনেপ্রাণে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সাতদলীয় জোটের সাথে থাকতেন, তাহলে এরশাদ এত দিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন না। আসলে এরশাদ আন্দোলন থেকে বিরত থাকার জন্য শেখ হাসিনাকে প্ররোচিত করতে পারলেও বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেননি।

দলীয় সংগঠন শক্তিশালী করা এবং আন্দোলনকে বেগবান করার ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার ভূমিকা ছিল খুবই কার্যকর। সে সময় তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন। আমিও তাঁর সাথে খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অন্যান্য স্থানে গিয়েছি। বিভিন্ন জনসভায় যোগদান করেছি। আমরা গ্রামেগঞ্জে গিয়েছি। আমাদের সে সময় অর্থ ছিল না, গাড়ি ছিল না। আমাদের সমর্থকেরা সে সময় সাহায্য করেছে। বিভিন্ন জনসভায় বেগম জিয়ার ভাষণ শুনে আমি অবাক হয়েছি। আস্তে আস্তে এবং অত্যন্ত অল্পদিনের মধ্যে তিনি সুন্দরভাবে বক্তৃতা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন একজন গৃহবধূ। তিনি কোনো অনুষ্ঠানে যেতেন না। আমার স্ত্রী তাঁকে বলতেন, বিভিন্ন স্কুলে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে আপনি যান না কেন? উত্তরে বেগম জিয়া বলতেন, উনি (অর্থাৎ জিয়াউর রহমান) পছন্দ করেন না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আন্দোলনকে যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যান, তা ভাবতে অবাক লাগে। তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল গভীর। অতি সম্প্রতি (২০০৬) ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আমাকে বলেন, আপনাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে যতবার দেখা করেছি, ততবারই আমার মনে হয়েছে আগের চেয়ে তিনি বেশি কনফিডেন্ট এবং মোর অ্যাশিওরিং। তা ছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার আরেকটা বড় গুণ ছিল, তিনি সবকিছু মনে রাখতে পারতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর।

১৯৯১ সালে নির্বাচনে জয়ী হলো বিএনপি; ‘ভি’ চিহ্নে তা প্রকাশে খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি
ছবি কতৃজ্ঞতা: মো. লুৎফর রহমান বীনু

শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট এরশাদ বিএনপির কাছে প্রস্তাব দেয়, আসুন আমরা সিট ভাগাভাগি করি এবং সবাই নির্বাচনে অংশ নেই। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্টভাবে বলেন, আমরা তো নির্বাচন করব না। সিট ভাগাভাগির তো প্রশ্নই আসে না। প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমাদেরকে অর্থাৎ বিএনপিকে ১২৬টি সিট দেওয়ার প্রস্তাব করেন। অন্য দলকেও কম-বেশি সিট বণ্টন করার কথা বলেন। এ সময় আমাদের দলের মধ্যে অনেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তা ছাড়া আর্থিক দিক থেকে বিএনপির অবস্থা ভালো ছিল না। সে কারণে অনেকে বলতে শুরু করেন, একটা প্রস্তাব যখন এসেছে, তখন ওই প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা করতে দোষ কী? প্রথমে ইলেকশনটা হোক। তারপর এরশাদকে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া যাবে। ওই সময় আমার মতও নির্বাচনের দিকেই ছিল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, আমরা এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করছি। সেই এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনে যাব না। ফলে বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

১৯৮৬ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (প্রেসিডেন্ট এরশাদের দল) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের অবস্থা ভালো ছিল না। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। সেই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি জনাব মো. মাসউদ। তিনি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে যে সার্টিফিকেট দেন, তাতে আমরা সবাই অবাক হই। বিচারপতিদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা। ওই সার্টিফিকেট দেওয়ায় বিচারপতিদের ওপর আমার দৃঢ় আস্থার ভিত্তি অনেকটা ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু নির্বাচন হলেও এরশাদবিরোধী আন্দোলন থামল না, বরং আগের চেয়ে তার গতি তীব্র হলো। বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, আগে থেকেই রাজপথের আন্দোলনে ছিল। অন্যান্য দলও আস্তে আস্তে রাজপথের আন্দোলন শুরু করল। আগের মতো আবার সব রাজনৈতিক দল বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করল। এরই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট এরশাদ ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেন। এরপর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। ওই নির্বাচনে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেনি। একমাত্র জাতীয় পার্টি ও জনাব আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে একটি সম্মিলিত দল (৭২টি দলের সমন্বয়ে গঠিত) ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫১টি আসন লাভ করে। কিন্তু ওই নির্বাচন দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ সময়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ক্রমেই জোরদার হতে থাকে; একই সঙ্গে জোরদার হয় এরশাদবিরোধী আন্দোলন।

প্রবল ওই আন্দোলনের মুখে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের কার্যব্যবস্থা ঠিক করা হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করবেন। ওই শূন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ করা হবে তিন জোটের মনোনীত ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি জনাব সাহাবুদ্দীন আহমদকে। অতঃপর এরশাদ পদত্যাগ করবেন। আর এরশাদ পদত্যাগ করলে ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করবেন অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এ রকম ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তা কার্যকর করা হয় ৬ ডিসেম্বর (১৯৯০)। প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করার পর এরশাদ পদত্যাগ করেন।