স্বাস্থ্যে প্রকল্প থেকে সরছে সরকার: ১৭ মাস বেতনহীন, চাকরি হারানোর শঙ্কা

কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টে অস্থায়ী ভিত্তিতে কর্মরত অনেকের চাকরি হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি) নানা দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নামেনফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। দুই হাজারের বেশি কর্মী ১৭ মাস বেতন–ভাতা পাচ্ছেন না। অনেকের চাকরিচ্যুতির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এতে কিছু সেবা চালিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।

১৯৯৮ সালে সরকার স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি (সেক্টর প্রোগ্রাম নামে পরিচিত) শুরু করেছিল। এ পর্যন্ত সরকারের চারটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। সর্বশেষ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। পরের মাস জুলাই থেকে পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল।

৩০টির বেশি অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতো। অপারেশন প্ল্যানগুলো ছিল এক একটি পৃথক প্রকল্প। এসব প্রকল্পে বিভিন্ন দাতা সংস্থা তাদের সামর্থ্য ও স্বার্থ অনুযায়ী অর্থসহায়তা দিত। এসব প্রকল্পে স্বাস্থ্য বিভাগের নিজস্ব জনবল ছিল। পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক অস্থায়ী জনবলও ছিল।

১৯৯৮ সালে সরকার ‘সেক্টর প্রোগ্রাম’ শুরু করেছিল। ৩০টির বেশি অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতো। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এ কর্মসূচি বন্ধ। অস্থায়ীভাবে থাকা অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাদ পড়ছেন। যাঁরা আছেন, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অনেকের বেতন-ভাতাও বন্ধ।

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় হঠাৎই অন্তর্বর্তী সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। এ কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন অস্থায়ীভাবে থাকা অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাদ পড়ছেন। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অনেকের বেতন–ভাতা বন্ধ। অন্যদিকে দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ড অর্থসহায়তা কমিয়ে দেওয়ার কারণে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে যুক্ত জনবলের একটি অংশ ৩১ ডিসেম্বরের পর আর চাকরিতে থাকতে পারবে না।

তবে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম চেষ্টা করছেন সেক্টর প্রোগ্রামে যাঁরা অস্থায়ী নিয়োগে চাকরি করতেন, তাঁরা যেন স্বাস্থ্য বিভাগের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতে কাজ করার সুযোগ পান।

গত ৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, সেক্টর কর্মসূচি শেষে স্বাস্থ্য বিভাগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ডিপিপির (ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান বা বিস্তারিত প্রকল্প পরিকল্পনা) প্রস্তাব করা হয়েছে। সেক্টর কর্মসূচিতে কাজ করা জনবলকে ডিপিপিতে ‘ক্যারিড ওভার’ করা হবে।

এমন পদক্ষেপ আগেও নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে পর্যায়ভিত্তিক নিয়োগ করা জনবল পরবর্তী প্রকল্পে অব্যাহত রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়।

কেন সেক্টর কর্মসূচি বাদ

একসময় স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচি ও এর অপারেশন প্ল্যানগুলোতে দাতা সংস্থার অর্থায়ন বেশি ছিল। এখন তা কমে এসেছে। স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচিতে এখন বেশির ভাগ অর্থায়ন সরকারের। তাই প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি থেকে সরে এসে সব কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্যের মূল কাঠামোতে যুক্ত করা প্রয়োজন মনে করছে সরকার।

৬ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সেক্টর কর্মসূচির দুর্বলতা ও এই কর্মসূচি থেকে সরে আসার যুক্তি তুলে ধরা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণীতে অন্তত সাতটি সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ আছে। এক, রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় কাজের ডুপ্লিকেশন ও ওভারল্যাপিং হয়। দুই, স্থায়ী কাজ বাধাগ্রস্ত হতে দেখা গেছে উন্নয়ন বাজেটের কারণে। তিন, ২৬ বছর চলার পরও স্বাস্থ্য খাতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক স্থায়ী কাঠামো গড়ে ওঠেনি। চার. পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে ও শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ অনুভূত হয়নি। পাঁচ, দাতা সংস্থার অর্থায়নে অনেকে বেতন পায় বলে বেতনবৈষম্য তৈরি হয়েছে। ছয়, অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে স্থাপনা তৈরি হলেও জনবল তৈরি ও সেবা চালু হয়নি। সাত, অনেক ক্ষেত্রে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।

স্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ায় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, এইচআইভি-এইডস, পুষ্টিসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে শিথিলতা এসেছে। এতে রোগ বেড়ে যেতে পারে—এমন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, ইউএসএআইডি, জাইকা, ডিফিডসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা সেক্টর কর্মসূচিতে যুক্ত ছিল। বেশ কিছু দেশের দূতাবাস ছোট–বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় সেক্টর কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত ছিল। এদের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কর্মসূচি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি ২৬ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এতকাল দাতাদের অর্থে, পরামর্শে চলেছে। এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দাতা সংস্থা, এমনকি দেশের জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়েরও প্রয়োজন বোধ করল না। এটা দুঃখজনক।’

ঢাকার আজিমপুরের এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র আগে থেকে ধুঁকছিল। এখন টিকে থাকা নিয়েই সংশয়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

কারা বাদ পড়ছেন

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন অপারেশন প্ল্যানের আওতায় কর্মরত ১৫ হাজার ৯৭২ জনকে পরবর্তী পরিকল্পনায় ক্যারিড ওভার করার প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টে কর্মরত ১৩ হাজার ৩২৪ কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপি) গত বছরের ডিসেম্বরে রাজস্বখাতভুক্ত করে সরকারি চাকরিতে স্থায়ী করা হয়। অবশিষ্ট ২ হাজার ৬৪৮ জনের ভাগ্য ঝুলে আছে।

যক্ষ্মা কর্মসূচিতে থাকা একজন নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি ১০ বছরের বেশি সময় জেলা পর্যায়ে কাজ করেছি। ১৭ মাস ধরে বেতন পাচ্ছি না। এখন শুনছি, আমাদের বাদ দেবে। এই বয়সে নতুন কাজ পাওয়াও কঠিন। আমাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতারও কোনো দাম নেই?’

গত তিন মাসে জাতীয় যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার, পুষ্টি সেবা কর্মসূচি, এইচআইভি–এইডস কর্মসূচি, শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মরত চিকিৎসক, টেকনোলজিস্টসহ নানা পদাধিকারীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, সরকার তাঁদের রাখবে কি রাখবে না, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলছে না। মাঠপর্যায়ে ব্যাপক হতাশা। অনেক সেবা কার্যত বন্ধ হয়ে আছে।

যেমন ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের সেবা কার্যত বন্ধ। ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ১১টি জেলা সদর হাসপাতালে এসব কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব কেন্দ্রে শিশুদের স্নায়ুবিকাশ সমস্যা, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক সমস্যা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, দেরিতে কথা বলা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রম, অটিজম, মৃগীরোগ—এসব বিষয়ে সেবা দেওয়া হতো। এসব কেন্দ্র থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি শিশু সেবা পেয়েছে। এখন শিশুরা সেবা পাচ্ছে না বললেই চলে। এই বিশেষায়িত সেবা আবার পূর্ণোদ্যমে চালু হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে।

আরও পড়ুন

এরই মধ্যে ২০ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে একটি স্মারকে বলা হয়েছে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ড থেকে বেতন–ভাতা পাওয়া কর্মকর্তা–কর্মচারীদের চাকরি আগামী ৩১ ডিসেম্বরে শেষ হবে। তাঁদের মধ্যে আছেন ডিস্ট্রিকট সার্ভিল্যান্স মেডিকেল অফিসার, প্রোগাম অর্গানাইজার, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) ও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওলজি)। তাঁদের সংখ্যা ৬৩৪।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এসব কারণে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, এইচআইভি–এইডস, পুষ্টিসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে শিথিলতা এসেছে। এতে রোগ বেড়ে যেতে পারে—এমন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

১৮ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের পদ ও জনবল বিষয়ে একটি সভা হয়। তাতে অর্থ মন্ত্রণালয় ১ হাজার ৩৪৭টি পদে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়োগের কথা বলেছে। বিষয়টি ২ ডিসেম্বরের একনেকের সভায় চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা এখন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তাঁরা বলেছেন, একনেক সভার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।