আনন্দ ও অশ্রুমাখা সন্ধ্যাটা

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

আমি তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। বক্তব্য দেওয়ার অভ্যাস ছিল আমার আগে থেকে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২২–এর উপজেলা প্রতিযোগিতার নোটিশ দিতেই লুফে নিলাম সুযোগটা। নাম দিলাম বক্তব্য প্রতিযোগিতায়। প্রস্তুতি নিলাম যতটা পারি।

ঠিকঠাক সময়েই নির্ধারিত দিনে পৌঁছে গেলাম। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগেই ঘটল বিপত্তিটা। বক্তব্যের বদলে আমার নাম চলে গেল রচনা প্রতিযোগিতায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব! কোনো প্রস্তুতি নেই। অংশগ্রহণ করতে মনটা মোটেও সায় দিচ্ছিল না। চলে আসতে চাইলাম। পরে মনে হলো একটা অভিজ্ঞতা অন্তত হোক। যা আছে কপালে!

নির্ধারিত কক্ষে প্রবেশ করে দেখলাম প্রতিযোগীরা বই–খাতা খুলে মাথা গুঁজে পড়ছে। দেখে পুরোমাত্রায় দমে গেলাম। আমার সব প্রস্তুতি ছিল বক্তব্যকে ঘিরে, তাই একটা খাতা পর্যন্ত নিয়ে যাইনি। শুধু একটা বই নিয়েছিলাম, তা–ও ইতিহাসের বই। নিজেকে তখন সাগরের মাঝখানে হাবুডুবু করতে থাকা এক অসহায় বান্দার মতো মনে হচ্ছিল।

খাতা দেওয়ার পর আরেক সমস্যায় পড়লাম। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ব্যাগ থেকে পেনসিল, স্কেল বের করে রেখে দিয়েছিলাম, লাগবে না বলে! আশপাশে লক্ষ করলাম সবাই ব্যস্ত। কী আর করা! খাতা ভাঁজ করে, কলম দিয়েই মার্জিন করলাম।

একটু পরেই ঘোষণা করা হলো রচনার বিষয়—‘আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ’। মিনিট পাঁচেকের মতো হতভম্ব হয়ে বসেছিলাম। যখন সংবিত ফিরে পেলাম, তখন দেখলাম আমার পাশেরজন ভূমিকা লিখে আরেকটা প্যারা লিখতে শুরু করেছে। আমি তখনো রচনার নামটা পর্যন্ত লিখিনি। দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে লিখতে শুরু করলাম। ৩০ মিনিট পর স্যাররা খাতা নেওয়ার তোড়জোড় করছেন। এতক্ষণ আশপাশে কী ঘটেছে আমার কোনো খেয়াল ছিল না।

খাতা জমা দিয়ে আসার সময় জানতে পারলাম অন্য বিভাগের চেয়ে আমার বিভাগে প্রতিযোগী কম। তাই একটু আশার আলো দেখতে পেলাম।

ম্যামকে সাহস করে বলেই ফেললাম, ‘ম্যাম আমি তিনজনের মধ্যে একজন হব। ম্যাম জানালেন, ‘বিজয়ী তিনজন হয় না, প্রতিটি বিভাগে মাত্র একজনকে উপজেলার শ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।’

মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। শেষ আশাটাও বুঝি এভাবে ভেঙে যাবে! সন্ধ্যায় ফলাফল দেওয়ার কথা। আমি থেকে কী করব! তবু কিসের যেন টানে রয়ে গেলাম।

সন্ধ্যায় ফলাফল ঘোষণার আগে আমার ভেতরটা ভেঙে চুরমার হতে লাগল। অগ্রিম ব্যর্থতার তীব্র ব্যথাটা অনুভব হতে লাগল প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে। কারণ, একটু পরেই ঘোষণা করা হবে ফলাফল, সঙ্গে আমার ব্যর্থতার অঘোষিত ঘোষণা।

শক্ত হয়ে বসে হাত দুটো মুঠো করে চোখের জল কোনোমতে আটকে রেখে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছিলাম।

পরের মুহূর্তটা ছিল আমার জন্য একেবারেই অভাবনীয়! সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে রচনা প্রতিযোগিতায় ‘উপজেলা শ্রেষ্ঠ’র স্থানে উচ্চারিত হয়েছিল—আদনান ফাতেমা, চকরিয়া আবাসিক মহিলা কলেজ।

সন্ধ্যার ওই মুহূর্তটার কথা মনে পড়লে আমি এখনো আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। চোখ ফেটে জল আসে। তবে সেটা কষ্টের নয়, আনন্দের, বিস্ময়ের!

সেদিন কী লিখেছিলাম, তা অবশ্য এখন ভুলে গেছি। তবে যা মনে পড়ে তা হলো, ছোটবেলা থেকেই আমি দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতাম। আমার সেই স্বপ্নের সারসংক্ষেপই লিখেছিলাম সেদিন।