নির্বাচন একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে

সুজন আয়োজিত ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন: প্রসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক অনলাইন বৈঠকে বক্তারা
ছবি: সংগৃহীত

নির্বাচন এখন একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন বিরোধী দল আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে আসন্ন পাঁচ সিটির নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও তা গ্রহণযোগ্য বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে না।

গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট—এই পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সামনে রেখে আজ রোববার এক অনলাইন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন: প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এ বৈঠক আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। আলোচনায় গত কয়েক বছরে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং আগামী সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গও উঠে আসে।

সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যে মনোভাব প্রয়োজন, তা কারও মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। কেউ চায় না সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। তাই সেই ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ভোটাররাই নির্বাচনের প্রধান অংশীজন। নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেন। নির্বাচন কমিশন এখন সেটা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এখনকার পরিস্থিতিতে সরকারি দলকে খোলা ময়দান দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দিয়ে ইসির সক্ষমতা বোঝা যাবে না। কারণ, এটি একপক্ষীয় নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বী যাঁরা আছেন, তাঁরাও দুর্বল।

বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এবারের সিটি নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল নেই। এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, নির্বাচন অর্থ বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের সব মানদণ্ড পূরণ হলেও এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।

নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট সংকটের বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিকদেরই সমাধান করতে হবে। রাজনীতিকদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। তুরস্ক বা থাইল্যান্ডে কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে; কারণ, তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়নি।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন একটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনে যত কম দল অংশ নিচ্ছে, যত কম মানুষ ভোট দিচ্ছেন, তত বেশি ক্ষমতাসীনদের জন্য সুবিধা হচ্ছে। ভোট হবে কিন্তু ভোটার কেন্দ্রে যাবেন না, এটা যেন রীতি হয়ে গেছে। ভোটবিহীন নির্বাচন ‘সিস্টেমের শক্তিশালী অঙ্গ’ হয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, নির্বাচনগুলো কয়েকটি বার্তা দেয়। যেমন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে প্রকাশ্যেই অনিয়ম হবে, পুলিশ ও প্রশাসন ন্যক্কারজনকভাবে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অবস্থান নেবে, ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা ক্রমে কমবে।

আসিফ নজরুলের দাবি, পুলিশ–প্রশাসনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে তাদের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। এখনকার পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। আরেকটা হতে পারে বর্তমান সরকারপ্রধানকে পরিবর্তন করে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করে নির্বাচন দেওয়া।

আসিফ নজরুলের বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। আসিফ নজরুলের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এটি হচ্ছে বিএনপি যাতে ক্ষমতায় আসে, তার জন্য একটি সমায়িক ব্যবস্থার ইঙ্গিত। তারাও ক্ষমতায় গিয়ে প্রথমেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেবে। তাই একটি স্থায়ী ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে।

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, কয়েকটি দল অংশ না নেওয়ায় সিটি নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের একটা বড় অংশের উৎসাহ থাকবে না। তারপরও যাঁরা অংশ নিচ্ছেন, তাঁরা যাতে সমান সুযোগ পান সংশ্লিষ্টদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতাটা হলো, নির্বাচন কমিশন ও ক্ষমতাসীনেরা সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।

বৈঠকের শুরুতে লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটির নির্বাচন কেমন হবে, সেটা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। ফলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের যে প্রত্যাশা, তা পূরণ হচ্ছে না।

এর আগে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি নির্বাচনে নানা অনিয়ম, নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে পুলিশ–প্রশাসনের ভূমিকার কথা তুলে ধরে দিলীপ কুমার বলেন, এখন দেখার বিষয় এই নির্বাচনে গত নির্বাচনের নেতিবাচক অনুষঙ্গগুলো থাকে কি না।