অনিবন্ধিত নৌযানের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনলে এমন দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব হবে না: মো. ইমরান উদ্দিন

পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত ৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই নিখোঁজ। এ দুর্ঘটনা, দেশের নৌযান পরিস্থিতি, নৌপথের নিরাপত্তা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. ইমরান উদ্দিন। তিনি নৌযানের দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. ইমরান উদ্দিন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে এখন পর্যন্ত ৩৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কী বলবেন এ দুর্ঘটনা নিয়ে?

ইমরান উদ্দিন: যে নৌকাটিতে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, এটি কোনো নিবন্ধিত নৌযান নয়। আমাদের দেশে যত নৌযান চলে, সেগুলোর অধিকাংশই অনিবন্ধিত। দেশে নিবন্ধিতের চেয়ে অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা তিন থেকে চার গুণ বেশি। এটা অনুমিত সংখ্যা। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তর একটি প্রকল্প হাতে নিয়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল। যেখানে এসব অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা কত তা নির্ধারণ করা এবং পরবর্তী সময় এগুলোকে কীভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনা যায়, সে প্রক্রিয়া ঠিক করার কথা ছিল। কিন্তু এ প্রকল্প আর শেষ হয়নি। প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা যেত।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নিবন্ধন করা হলে কী সুবিধা হতো?

ইমরান উদ্দিন: অনিবন্ধিত নৌযানের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এখানকার চালকেরা সাধারণত অদক্ষ হন। সরকারনির্ধারিত কোনো ঘাটে তারা যাত্রী নিতে পারে না। নিবন্ধন হলে কতজন যাত্রী নিচ্ছে, কীভাবে পারাপার হচ্ছে—এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকত। দ্বিতীয় বিষয় হলো, এখানে নৌযানগুলো আদৌ চলাচলের উপযোগী কি না, তা–ও জানা যায় না। এসবের ধারণক্ষমতা জানা যায় না। আমাদের দেশে নিবন্ধিত নৌযানের চালকদেরই অনেক সময় প্রশিক্ষণ থাকে না। সেখানে এসব অনিবন্ধিত নৌযানের কী হাল, সেটা তো বোঝাই যায়।  

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: নিবন্ধিত নৌযানে দুর্ঘটনার সংখ্যা কি বেশি?

ইমরান উদ্দিন: এর সঠিক কোনো হিসাব নেই। কারণ, অনিবন্ধিত নৌযানের দুর্ঘটনার খবর খুব বেশি আসে না। উপকূলীয় এলাকার অনিবন্ধিত নৌযানের দুর্ঘটনার খবর কিছুটা আসে। বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে তা জানা যায়। অন্য অঞ্চলের খুব বেশি পাওয়া যায় না। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে অনিবন্ধিত নৌযানের দুর্ঘটনার তথ্য প্রায় থাকে না বললেই চলে। যেসব ঘটনা বড় হয় এবং আলোড়ন সৃষ্টি করে সেগুলোর কিছু আসে। মামলা হলে সেসবের সংখ্যা তারা আমলে নেয়।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আপনি বলছেন, অনিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা অনেক বেশি। দিনের পর দিন এসব চলছে, দুর্ঘটনায় পড়ছে, প্রাণহানি ঘটছে। তারপরও সেসবের ওপর কোনো নজরদারি নেই। কীসের ঘাটতিতে এটা হচ্ছে?

ইমরান উদ্দিন: আমার মনে হয়, এটা সদিচ্ছা ও সুশাসনের অভাব। এসব বিষয় নিয়ে অনেক আগে কথা উঠেছে। সরকার প্রকল্পও নিয়েছে। কিন্তু এসব কেন এগোয়নি, এর উত্তর তো সরকারি দপ্তরই বলতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একটি নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে সেখানে যাত্রীদের সুরক্ষায় কী ব্যবস্থা থাকা উচিত?

ইমরান উদ্দিন: নৌযানে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বয়া থাকতে হবে। শুধু থাকলেই হবে না, সেগুলোকে ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় রাখতে হবে। এসব নৌযানে রেখে যদি কোনো লকারে বন্দী করে রাখা হয় তাহলে তো কোনো কাজে আসবে না। আগের অনেক ঘটনায় আমরা এমনটা দেখেছি। আর নদীতে কত পানি আছে সেটি বিবেচ্য নয়। পাঁচ-ছয় ফুট পানিতে পড়েও সাঁতার না–জানা থাকলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। সে ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামগুলো থাকা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি যাত্রীদেরও অসচেতনতা আছে। তাঁদেরও সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: আমরা কথা বলছি অনিবন্ধিত নৌযান নিয়ে। সেখানে তো এসব বিষয় একেবারেই মেনে চলা হয় না।

ইমরান উদ্দিন: নিবন্ধিত নৌযানেই অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয় মেনে চলা হয় না। আর অনিবন্ধিত নৌযানে তো এসবের প্রশ্নই আসে না। সরকারি দপ্তরের হিসাবের মধ্যেই তো তারা নেই।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: মোটরবাইকে হেলমেট পরার বিষয়টি ঢাকা বা বড় শহরাঞ্চলে কিছুটা নিশ্চিত করা গেছে। মফস্‌সলের নৌযানগুলো যেখানে খেয়া পারাপার হয়, সেখানে সুরক্ষাসামগ্রী রাখার বিষয়টি  প্রয়োগ করাটা আদৌ সম্ভব?

ইমরান উদ্দিন: আমরা কিন্তু দেখেছি, স্পিডবোটে লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়। হাতিরঝিলে যেসব ওয়াটার ট্যাক্সি চলে, সেখানেও লাইফ জ্যাকেট দেওয়া হয়। নৌযানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনলে এসব করা সম্ভব। এটা কঠিন কাজ হবে না। এখানে উদ্যোগের অভাবই বড় সমস্যা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দুর্ঘটনা রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়?

ইমরান উদ্দিন: সে কথা আগেই বলেছি, সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। এর জন্য আগে চাই সমীক্ষা। আমাদের কতগুলো নৌযান আছে, সেটাই তো আমরা সঠিকভাবে জানি না। নৌযানচালকদের উৎসাহ দিতে হবে। পরে চালকদের প্রশিক্ষণ এবং রুট নির্ধারণ করে দেওয়া এবং কত যাত্রী পরিবহন করতে পারবে, তা ঠিক করে দিতে হবে। অনিবন্ধিত নৌযানের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না আনলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। বছরে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে, আমরা এ নিয়ে কথা বলি। তখন নানা পদক্ষেপের কথা বলা হয়। কিন্তু পরে সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না। করতোয়ায় দুর্ঘটনায় দেখা গেল, ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী নেওয়া হয়েছিল। এখানে অব্যবস্থাপনাই বড় বিষয় ছিল। নজরদারি থাকলে এমনটা হতো না।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: প্রান্তিক পর্যায়ে দুর্ঘটনা রোধে যে প্রক্রিয়াগুলোর কথা আপনি বললেন, সেখানে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে যুক্ত করা যায় কি না?

ইমরান উদ্দিন: অবশ্যই, বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। সে ক্ষেত্রে নজরদারির বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে পারলে কাজটি অনেক সহজ হবে।