নিরাপদ সড়কের নির্দেশনা কাগজে–কলমেই আটকা

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের আগস্টে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ঢাকা মহানগর পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাও নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছিল। বলেছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রশাসনের খুলে যাওয়া চোখ বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীম নিহত হন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেদিন আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। সেই আন্দোলন দেশবাসীর সমর্থন পেয়েছিল। টানা ৯ দিন রাজপথে আন্দোলনের পর সরকারের আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যায় শিক্ষার্থীরা।

সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়। একাধিক সভা করার পরে ২০১৮ সালের আগস্টে কমিটি ১৭টি নির্দেশনা দেয়। এগুলোর অধিকাংশই সড়ক শৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। কিন্তু এগুলো কাগজে-কলমেই আটকে আছে, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

গত বছরের ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহনের গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবার রাজপথে নামেন শিক্ষার্থীরা। সেবারও সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে ১৭ দিন পর আন্দোলন স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা।

গত ১৩ জুলাই মিরপুর-১৪ নম্বরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় সাব্বির আহমেদ নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় সিটি করপোরেশনের গাড়িচালকের গাফিলতি ছিল বলে সংস্থাগুলোর তদন্তে এসেছে। অথচ ২০১৮ সালেই প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কমিটি নির্দেশনা দিয়েছিল, ঢাকায় অবস্থিত সব সংস্থার আওতাধীন যানবাহন এবং কর্মচারীরা যেন ট্রাফিক আইন মেনে চলে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সংস্থার প্রধানদের বিষয়টি মনিটরিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

সিটি করপোরেশনের মনিটরিং বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, সিসি ক্যামেরা বসালে সেটি দেখভাল এবং সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করবে কারা, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিটি করপোরেশন ও পুলিশ মিলে সমন্বিতভাবে কাজটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি চালানোয় বিশৃঙ্খলা ছিল। অধিকাংশ চালকের লাইসেন্স ছিল না। নতুন করে চালক নিয়োগ দিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়া নির্দেশনার একটিতে বলা হয়, গণপরিবহনে দৃশ্যমান দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর এবং মোবাইল নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে। গত শুক্রবার অন্তত ১০টি বাসে উঠে দেখা যায়, কোনো বাসেই ছবিসহ লাইসেন্স, মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান জায়গায় প্রদর্শন করা হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে ডাকাতি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে গণপরিবহন। বেশ কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, পরিবহনশ্রমিকেরাই ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাসচালকেরা নাম, নম্বর ও লাইসেন্স দৃশ্যমান রাখার নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে এমন অপরাধ অনেকটাই একমত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

গত মাসে প্রকাশিত এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে গণপরিবহনে সর্বশেষ ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৬৩ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সাড়ে ৪৬ শতাংশকে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি: কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শীর্ষক জরিপটি পরিচালনা করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। জরিপে ঢাকার বাস, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং যানবাহনের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বেসরকারি নারী সংগঠন আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্দেশনা বা নীতিমালা সহজেই করা হয়, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে কোনো কাজ হয় না। যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরা তা পালন করতে চান না। ধর্ষণ বা নিপীড়নের ঘটনার বিচার পেতে দীর্ঘসময় লাগে, যা অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করে। পরিবহন খাতের লোকজন এত ক্ষমতাধর, তাঁদের মধ্যে যা ইচ্ছে, তাই করতে পারার মানসিকতা তৈরি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সেই ১৭টি নির্দেশনায় ঢাকা শহরের ১৪০টি বাসস্টপেজ চিহ্নিত এবং সুসজ্জিত করা, নির্ধারিত স্টপেজে বাস থামা এবং যাত্রী উঠা-নামা নিশ্চিত করার নির্দেশনা ছিল। রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়, আসাদগেট, ফার্মগেট ও মহাখালী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাস থেকে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ হয়নি। কমিটির নির্দেশনা মেনে সে সময় বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাস থামার জায়গা চিহ্নিত করে ছোট বোর্ডে নির্দেশনা লাগিয়েছিল ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। যার অধিকাংশই এখন আর দেখা যায় না।

ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এখন চলছে সনাতন পদ্ধতিতে। ট্রাফিক সদস্যরা হাত দিয়েই যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করেন। কোনো ধরনের সংকেতবাতি এখন আর ঢাকায় কাজ করে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা ছিল রাজধানীতে অটোমেটিক সিগন্যাল পদ্ধতি চালু করতে হবে। কিন্তু চার বছরেও এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই।

আরেকটি নির্দেশনা ছিল চলাচলের সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। অথচ রাজধানীতে চলাচলকারী অধিকাংশ চলন্ত বাসের দরজা খোলাই থাকে। কোথাও দায়িত্বরত ট্রাফিক সদস্যদের দেখলে বাসচালকের সহকারীরা তড়িঘড়ি করে বাসের দরজা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করেন।

ট্রাফিক শৃঙ্খলা বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই কাজগুলো নিয়মিত কার্যক্রমেরই অংশ। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় ট্রাফিক সদস্যরা নিয়মিত যানবাহন পরীক্ষা করেন। নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে বিশেষ কার্যক্রম চালানো হবে।

এসব অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে নির্দেশনাগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে। বিভিন্ন মিটিংয়ে বিষয়গুলো অনুসরণ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। গত ২৪ জুলাই রাজধানীতে এক নারী শিক্ষার্থী বাসে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। অপরাধীদের ধরতে মালিক সমিতি পুলিশকে সহায়তা করেছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন
ফাইল ছবি

সড়কের যেসব জায়গায় পদচারী সেতু আছে, সেসব জায়গায় দুই পাশের একশ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিছু এলাকায় সড়ক বিভাজক উঁচু করে পথচারী পারাপার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। আবার কিছু এলাকায় পদচারী সেতুর কাছেই গাড়ি ইউটার্ন নেওয়ার জায়গা, ফলে সেই সড়কগুলো খোলা থাকায় পথচারীরা নিচ দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছে। পদচারী সেতুগুলোর পরিচ্ছন্নতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বাতি ও সিসিটিভি স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কমিটি। অথচ ঢাকার সব পদচারী সেতুতে এখনো সন্ধ্যার পরে বাতি জ্বলার ও সিসিটিভির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন।

সড়কে চলাচলকারী সব পরিবহনে, বিশেষ করে দূরপাল্লার বাসে চালক এবং যাত্রীর সিট বেল্ট ব্যবহারের নিশ্চিত করতে বলেছিল প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কমিটি। এ ছাড়াও ফুটপাত হকারমুক্ত করা, সাদা রং দিয়ে সড়কের পার্কিং লেন আলাদা করা এবং পার্কিংয়ের সময় ও গাড়ির সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নির্দেশনাও ছিল। গত চার বছরে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন প্রথম আলোকে বলেন, মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনের নেতা তো মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরাই। সংগঠনে সরকারের লোক থাকায়, তাঁরা বেপরোয়া। সরকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা যায়, সেটাও করা হচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কষ্টসাধ্য।