প্রবীণনিবাস ছাড়তে চাননি, নিবাসেই মারা গেলেন

হামদুল্লাহ ফারুকের মরদেহ নিয়ে যান তাঁর স্বজনেরাছবি: সংগৃহীত

হামদুল্লাহ ফারুকের বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে প্রবীণহিতৈষী সংঘের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। এ নিবাসেই যাতে মৃত্যু হয়, এটাই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা। আজ বুধবার সকালে তিনি নিবাসেই মারা গেছেন।
২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে হামদুল্লাহ ফারুক নিবাসটিতে ছিলেন। সেখানে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দা। এ নিবাসের বাসিন্দা হওয়ার আবেদনপত্রে তিনি লিখেছিলেন, ঢাকায় তাঁর থাকার কোনো জায়গা নেই। একাকিত্বসহ নানা কারণে তিনি নিবাসে থাকতে চান।

বাংলাদেশ প্রবীণহিতৈষী সংঘ ও জরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানটি (বাইগাম) যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৬০ সালে। প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মেডিসিন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম আবদুল ওয়াহেদ রাজধানীর ধানমন্ডিতে তাঁর বাসভবনে বাইগাম গড়ে তুলেছিলেন। বর্তমানে আগারগাঁওয়ে সংঘের প্রবীণ ভবনে আছে ৫০ শয্যার প্রবীণ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট অব জেরিয়েট্রিক মেডিসিন (আইজিএম) এবং পাশে একটি ভবনে ৫০ শয্যার প্রবীণনিবাস।

প্রবীণনিবাসে বাসিন্দা ছিলেন ৩৬ জন। মার্চে একজন এবং এবার ঈদুল ফিতরের পরের দিন ১২ এপ্রিল মারা যান আরেক প্রবীণ সদস্য। আর আজ মারা গেলেন হামদুল্লাহ ফারুক। এখানকার সদস্যদের নির্দিষ্ট ফি দিয়ে থাকতে হয়।

বাইগামের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. মহসীন কবির আজ তাঁর ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, হামদুল্লাহ ফারুকের পরিবার বিভিন্ন সময় তাঁকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। একবার নিয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিবাস ছেড়ে যাবেন না বলে কখনোই পরিবারের কাছে থাকেননি। নিবাসের কর্মীরাই তাঁর আপনজনে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিবাসেই তিনি মারা গেলেন।

মো. মহসীন কবির প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ দিন আগে বার্ধক্যের কারণে হামদুল্লাহ ফারুক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর পরিবারকে খবর দেওয়া হয়। পরিবারের সদস্যরা এসে তাঁকে রাজধানীর একটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করান। অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকেরা জানান, পরিবার চাইলে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে। তবে তিনি বাড়ি না ফিরে নিবাসে আসতে চান বলে স্বজনদের জানিয়ে দেন।

এ খবর জানালে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁকে নিবাসে আনেন স্বজনেরা। নিবাসের যতটুকু সামর্থ্য আছে, তা দিয়েই অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আজ সকালে তিনি মারা যান। এ সময় তাঁর স্বজনদের পাশাপাশি নিবাসের কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

মো. মহসীন কবির জানান, হামদুল্লাহ ফারুক পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর এক ছেলে মারা গেছেন। আর এক মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। তাঁর নাতনি মেরিনা মিতু সব সময় হামদুল্লাহ ফারুকের খোঁজখবর নিতেন। হামদুল্লাহ ফারুকের বাড়ি ছিল নড়াইলে। তবে মেরিনা নানার লাশ দাফনের জন্য তাঁর বাড়ি নরসিংদীতে নিয়ে গেছেন।

কথা হলো মেরিনা মিতুর সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর মা দেশের বাইরে থাকেন। লাশ দাফন এবং গ্রামের বাড়িতে নেটওয়ার্ক-সংক্রান্ত ঝামেলায় তিনি এর বেশি কথা বলতে পারেননি।

হামদুল্লাহ ফারুক ছিলেন আগারগাঁও প্রবীণনিবাসের সবচেয়ে বয়স্ক বাসিন্দা
ছবি: সংগৃহীত

বাইগামের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. মহসীন কবির জানান, হামদুল্লাহ ফারুক স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। সব সময় পরিপাটি থাকতে পছন্দ করতেন। তাঁর জীবনের গল্প শুনতে চাইলে হাসিমুখেই তা এড়িয়ে গেছেন। পরিবার নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না। ঈদুল ফিতরের দিন নিবাসের ৫১৩ নম্বর কক্ষে মো. মহসীন কবির নিজে গিয়ে তাঁকে চকলেট দিয়ে এসেছিলেন।

কোনো প্রবীণ মারা গেলে স্বজনেরা যদি লাশ না নিতে চান, তখন নিবাসের পক্ষ থেকে কী করা হয়, তা জানতে চাইলে মো. মহসীন কবির বলেন, ‘তেমন পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত পড়তে হয়নি। তবে নিবাসের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রবীণ নিবাসে থাকতে চাইলে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম, ফোন নম্বর রাখা হয়। মারা গেলে খবর দিলে স্বজনেরা এসে লাশ নিয়ে যান। আর যদি কেউ লাশ নিতে না চান, তাহলে থানায় প্রবীণের মারা যাওয়ার খবরটি জানাতে হবে। তারপর নিবাসের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিবাসে মারা গেলে প্রতিষ্ঠানের হাসপাতাল থেকেই মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়।’

এক প্রবীণ সদস্যের মারা যাওয়ার পরের সময়কার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে মহসীন কবির বলেন, ‘তিনি যখন জীবিত ছিলেন, তখন তাঁর পরিবারের সদস্যরা তেমন খোঁজখবর নিতেন না। নিবাসের আশপাশেই স্বজনেরা থাকতেন। কিন্তু তিনি (ওই প্রবীণ) মারা গেছেন, এ খবর পাওয়ার পর দামি দামি গাড়ি হাঁকিয়ে স্বজনেরা এসে লাশ নিয়ে গেছেন।’

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী ৬০ বছর বা এর বেশি বয়সী ব্যক্তিরা প্রবীণ। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম ২০২৩-এর প্রাথমিক ফলাফল বলছে, ২০২৩ সালে দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের জনগোষ্ঠী ছিল মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।