৫৪ বছর বয়সে এভারেস্ট ম্যারাথনে 

এভারেস্ট ম্যারাথন শেষ করার পর জাতীয় পতাকা হাতে মো. মনিরুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

মো. মনিরুজ্জামানের বয়স প্রায় ৫৪ বছর। তাঁর বয়স দিয়েই যে এই প্রতিবেদন শুরু করতে হলো, তার কারণ আছে। পঞ্চাশোর্ধ্ব মনিরুজ্জামান গত ২৯ মে এভারেস্ট ম্যারাথনে অংশ নিয়ে পূর্ণ দূরত্বের পুরো পর্বটি সফলভাবে শেষ করেছেন।

২৯ মে ছিল এভারেস্ট দিবস। ১৯৫৩ সালের এই দিনেই এডমুন্ড হিলারি এবং তেনজিং নরগে শেরপা বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট প্রথমবার জয় করেছিলেন। এভারেস্ট দিবসে দুই বছর পরপর আয়োজন করা হয় ‘তেনজিং-হিলারি এভারেস্ট ম্যারাথন’। নেপাল সরকারের সহায়তায় হিমালয়ান এক্সপিডিশন এর আয়োজক। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ট্রেইল ম্যারাথন।

এভারেস্ট ম্যারাথন শেষ করে মনিরুজ্জামান ঢাকায় ফিরে এসেছেন ১ জুন। ম্যারাথন সম্পন্ন করার সনদ আর পদক হাতে সেদিনই সন্ধ্যায় এলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। বিস্তারিত বললেন তাঁর রোমাঞ্চকর এই অভিযাত্রা নিয়ে।

মো. মনিরুজ্জামান নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু গিয়েছিলেন ১৬ মে। ১৭ মে রওনা দেন খান্ডালা থেকে এভারেস্ট বেজক্যাম্পের পথে। বেজক্যাম্পের অবস্থান ৫,৩৬৪ মিটার উঁচুতে। সেখানে গিয়ে তাঁরা পৌঁছান ২৭ মে।

মনিরুজ্জামান বললেন, ‘এভারেস্ট পর্বতে বিরূপ আবহাওয়া আর উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাওয়ানোর জন্য আমাদের ট্রেকিং করে বেজক্যাম্প পর্যন্ত উঠতে হয়েছে। শুরুর পর থেকেই পায়ের তলায় কোনো মাটি ছিল না। শুধু পাথর আর বরফ।’

এবারের এভারেস্ট ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন ২৯টি দেশের ২০৫ জন। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিযোগী ছিলেন মনিরুজ্জামান।

এভারেস্ট বেজক্যাম্পে তাঁদের দুই দিন থাকতে হয়েছে পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে। এভারেস্ট ম্যারাথন তিনটি দূরত্বে হয়ে থাকে—২১, ৪২ ও ৮০ কিলোমিটারে। মনিরুজ্জামান অংশ নেন ৪২ কিলোমিটার ১৯৫ মিটার দূরত্বের ম্যারাথনে। এই দূরত্ব অলিম্পিক ম্যারাথনের সমান।

মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সকাল সাতটায় শুরু হলো ম্যারাথন। নির্ধারিত দূরত্ব শেষ হবে ৩,৫০০ মিটার উঁচু নামছে বাজারে।’

মানে, এই ম্যারাথনে কেবলই নেমে আসতে হয়। কেন, তার কারণ বুঝিয়ে বলেন মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘পর্বতে ওঠার চেয়ে নামা বেশি কঠিন। বেজক্যাম্প থেকে নামছে বাজার নিচের দিকে হলেও সেই ট্রেইলে চড়াই-উতরাই দুটিই আছে। সে চড়াই-উতরাই দৌড়ে পাড়ি দিতে হয়। একবার পাহাড়ে আরোহণ করতে হয় তো আরেকবার অবরোহণ।’

৪২ কিলোমিটারের এই এভারেস্ট ম্যারাথন শেষ করতে মনিরুজ্জামান সময় নিয়েছেন ১০ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড।

মো. মনিরুজ্জামানের পরিচয় দূরপাল্লার সাঁতারু হিসেবে। সাঁতরে বঙ্গোপসাগরে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন ১২ বার।

সাঁতার ছেড়ে হঠাৎ ম্যারাথন কেন? মনিরুজ্জামান বললেন, ‘দৌড়ের প্রতি আগ্রহ সব সময়ই ছিল। নিয়মিত দৌড়ও অনুশীলন করি। তাতেই মনে হলো কঠিন এই ম্যারাথনটা করে দেখি। নতুন একটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করব।’

পদক পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মো. মনিরুজ্জামানকে
ছবি: সংগৃহীত

মনিরুজ্জামান এর আগে একাধিক ম্যারাথনে অংশ নিয়েছেন। অংশ নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ম্যারাথন, ঢাকা ম্যারাথনে। মনিরুজ্জামান অবশ্য প্রতিদিনই হয় দৌড়, নয় সাঁতারের চর্চা করেন। তিনি জানালেন, ‘সপ্তাহের তিন-চার দিন আমি ২১ কিলোমিটার করে দৌড়াই। যেদিন দৌড়াই না, সেদিন সাঁতার কাটি। ফজরের নামাজের পর ঘুমানোর জন্য আর বিছানায় যাই না।’

বরিশালের গৌরনদীতে ১৯৬৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মনিরুজ্জামানের জন্ম। পেশাগত জীবনে তিনি চিত্রগ্রাহক। এখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঊর্ধ্বতন চিত্রগ্রাহক (সংবাদ)।

বিটিভিতে ২৩ বছরের কর্মজীবন তাঁর। বললেন, তাঁর সাঁতারের শুরু অ্যাডভেঞ্চারগুরু প্রয়াত কাজী হামিদুল হকের হাত ধরে। পরে ১৯ বার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়া লিপটন সরকারের কাছে উৎসাহ পেয়েছেন। আর ম্যারাথন দৌড়ের উৎসাহ পেয়েছেন আয়রনম্যান মোহাম্মদ শামসুজ্জামান আরাফাতের কাছ থেকে।

সাঁতার ও দৌড়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবারও ঝোঁক আছে মো. মনিরুজ্জামানের। ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গৌরনদী প্রতিবন্ধী স্কুল। মনিরুজ্জামান বললেন, ‘বিশেষ এই স্কুলে ১৬০ জন প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। আমার বাবা ২০০৪ সালে গৌরনদীতে কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই স্কুলের আয় প্রতিবন্ধী স্কুলে ব্যয় করি। আমরা ভাইবোনেরাও অর্থ দিয়ে থাকি।’

মো. মনিরুজ্জামানের আগে এভারেস্ট ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন জার্মানপ্রবাসী বাংলাদেশি শিবশঙ্কর পাল ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মোহাম্মদ মহসীন। 

এই দুজনই ২০১৯ সালের ২৯ মে এভারেস্ট ম্যারাথনের ৪২ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছিলেন।