এক দিনে এক ঠিকানায় ৪৩ জন্মনিবন্ধন সনদ

পাঁচ ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ৫৪৭টি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু। থানায় জিডি। কাউন্সিলরদের সঙ্গে আজ বৈঠকে বসবেন মেয়র।

জন্ম নিবন্ধন
প্রতীকী ছবি

চট্টগ্রাম নগরের উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের একটি পাড়ার নাম মাসুম ফকিরের বাড়ি। এই পাড়ার ঠিকানা দিয়ে ৪৩ জনের জন্মনিবন্ধন করা হয়েছে। তা–ও এক দিনে। কিন্তু যাঁদের নামে জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়া হয়েছে, তাঁদের কোনো অস্তিত্ব নেই পাড়াটিতে।

ওয়ার্ড কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, গত শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে জন্মনিবন্ধন সহকারীর আইডি হ্যাক করে ৮৪টি জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে এক ঠিকানার এই ৪৩টি সনদ। শুধু ঠিকানা নিয়ে জালিয়াতি হয়েছে এমন নয়, জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়া ব্যক্তিদের ঠিকানা ভিন্ন ভিন্ন হলেও অনেকগুলো আবেদনে একই মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ ২৮টি জেলার স্থায়ী ঠিকানা দেখানো হয়েছে এসব সনদে।

চক্রটিকে শনাক্তের কাজ শুরু হয়েছে
আসিফ মহিউদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রাম

আইডি হ্যাক করে জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সিটি করপোরেশনের আরও চারটি ওয়ার্ডে—আন্দরকিল্লা, উত্তর পাহাড়তলী, দক্ষিণ কাট্টলী ও দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর। এসব ওয়ার্ডের আইডি হ্যাক করে ইস্যু করা হয়েছে আরও ৪৬৩টি জন্মনিবন্ধন সনদ। অর্থাৎ জালিয়াতি করে বের করা সনদের সংখ্যা ৫৪৭। ১০ থেকে ১৯ জানুয়ারির মধ্যে এ জালিয়াতি হয়। তবে তা জানাজানি হয় গত শনিবার।

জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডে এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০২১ সালের জুনে জালিয়াতি করে চট্টগ্রাম নগরের তিনটি ওয়ার্ড (চকবাজার, দক্ষিণ ও উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড) থেকে ১৮টি জন্মনিবন্ধন সনদ (১২টি রোহিঙ্গা) নেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

ওয়ার্ড কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন জন্মনিবন্ধন সহকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সনদ বাবদ জমা হওয়া অর্থ ও সংখ্যা যাচাই করতে গিয়ে আইডি হ্যাকড হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন তাঁরা। এ জন্য আইনি পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এ পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী আজ সোমবার সব ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারী নিয়ে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।

জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করা হয়নি।

৪৩টি সনদ যে ঠিকানায়

চট্টগ্রাম নগরের বিমানবন্দর সড়কের কাঠগড় থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে গার্ড রুম সড়কের পাশে পাড়াটির অবস্থান। এখানে কিছু বাড়ি পাকা, কিছু বাড়ি আধা পাকা। ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে পাওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গতকাল বেলা সাড়ে তিনটায় ওই পাড়ায় গেলে এক বৃদ্ধ, দুজন মাঝবয়সী ও একজন তরুণের সঙ্গে কথা হয়।

উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়া ব্যক্তিদের নাম ও তাঁদের পিতা-মাতার নাম তাঁদের দেখানো হয়। নামগুলো দেখে তাঁরাও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। নামগুলো কেউ চিনতে পারছিলেন না।

মাসুম ফকিরের বাড়ির বাসিন্দা বৃদ্ধ মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী ও তরুণ ইউসুফ শাকিল বলেন, তাঁদের বাড়িতে প্রায় ৬০টি পরিবার আছে। মানুষ আছে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন শ। আর এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাই সবার পরিচিত। এক দিনেই এই বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে ৪৩ জন জন্মনিবন্ধন সনদ নিয়েছেন, তা অস্বাভাবিক। ইতিমধ্যে তেমন কোনো নতুন ভাড়াটেও আসেননি।

ঠিকানা ভিন্ন, মুঠোফোন নম্বর একই

হ্যাক করা জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়া ব্যক্তিদের একজন হাফেজ রজি উল্লাহ। কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার গয়ালমারা বালুখালী এলাকার এই বাসিন্দার বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হয়েছে উত্তর পতেঙ্গার মাসুম ফকিরের বাড়ি। আবার বাগেরহাটের কচুয়ার বাসিন্দা কাজী মোহাম্মদ মান্নুর বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ব কাঠগড়। দুজনের ঠিকানা ভিন্ন হলেও আবেদন ফরমে একই মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়।

৮৪টি জন্মনিবন্ধন সনদের মধ্যে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ১২টি আবেদন ফরম থেকে মুঠোফোন নম্বরগুলো নেওয়া হয়। কিন্তু দেখা গেছে, এই ১২টি আবেদনের মধ্যে ৮টিই করা হয়েছে একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে। এর মধ্যে ছয়জনের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে একটি। বাকি দুজনের ঠিকানা অন্য জায়গা। এই নম্বরে ফোন করা হলে অপর প্রান্ত থেকে বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া বাকি চারটি আবেদনের দুটি করা হয় একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে। আবেদনকারী মাহমুদা বেগম ও পারমিনা আক্তার সম্পর্কে বোন। তাঁদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে মাসুম ফকিরের বাড়ি। কিন্তু মুঠোফোন নম্বরে গতকাল সন্ধ্যায় ফোন দেওয়া হলে ওই প্রান্তের ব্যক্তি জানান, মাহমুদা ও পারমিনা নামে কাউকে তিনি চেনেন না। তাঁর মুঠোফোন নম্বর দিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদের আবেদন করার বিষয়টি জানেন না।

জন্মনিবন্ধন জালিয়াতির ঘটনার তদন্ত শুরু করেছেন বলে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আসিফ মহিউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চক্রটিকে শনাক্তের কাজ শুরু হয়েছে।