‘যেটুকু গয়না ছিল, বিক্রি করে মা আমাদের পড়িয়েছেন’

বিশ্ব মা দিবসে বেসরকারি ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১০ জন মাকে ‘গরবিনী মা-২০২৩’ সম্মাননা জানিয়েছে।

বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১০ জন মাকে ‘গরবিনী মা-২০২৩’ সম্মাননা জানিয়েছে। সম্মাননা অনুষ্ঠানে সন্তানেরা মায়েদের সামনে তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেনছবি: আশরাফুল আলম

দৈনিক কালবেলার সম্পাদক সন্তোষ শর্মা বললেন, তাঁর মা লেখাপড়া জানেন না। বাবা দিনমজুর ছিলেন, তাঁদের পাঁচ ভাইবোনের পড়াশোনার খবর রাখতেন না। কিন্তু মা চেয়েছেন, সন্তানদের যেভাবেই হোক পড়াশোনা করাবেন। যেটুকু গয়না ছিল, তা বিক্রি করে মা তাঁদের পড়িয়েছেন। এরপর তাঁরা ভাইবোনেরা মাকে সই করা শিখিয়েছেন। এখন মায়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে এবং তিনি একটি স্কুলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

লেখাপড়া ও চাকরি না করা মেয়েদের মা পছন্দ করেন না উল্লেখ করে সন্তোষ শর্মা বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে চাকরি করতে বাধ্য করেছেন মা। মায়ের বয়স এখন ৯৮ বছর। আমরা ধুমধাম করে মায়ের শততম জন্মবার্ষিকী পালন করতে চাই।’

সন্তোষ শর্মার মা চঞ্চলা রানী শর্মাসহ মঞ্চে বসা ১০ জন মায়ের মধ্যে কারও বয়স ৯৮ বছর আবার কারও ৭৬ বছর। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী এই মায়েরা বসে বসে শুনলেন তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের কতটুকু ভালোবাসেন, সে কথা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত সন্তানেরাও অকপটে মাকে ভালোবাসার কথা জানালেন। পাশাপাশি তাঁদের অর্জনের পেছনে মায়ের যে অবদান, শ্রম, কষ্ট, তা–ও জানিয়ে দিলেন। অন্য সময় এভাবে ঘটা করে হয়তো কখনোই মাকে এসব কথা বলার ফুরসত মেলেনি।

আজ রোববার বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে এই মা ও ছেলে–মেয়েরা হাজির হয়েছিলেন রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া কনভেনশন সেন্টারে। ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই ১০ জন মাকে ‘গরবিনী মা-২০২৩’ সম্মাননা জানিয়েছে। সম্মাননা অনুষ্ঠানে সন্তানেরা মায়েদের সামনে তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। এবার দশমবারের মতো মায়েদের সম্মাননা জানালেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারেরা।

সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানসহ অন্য অতিথিরা মায়েদের হাতে ক্রেস্ট, মেডেল, বিনা মূল্যে মাস্টার হেলথ চেকআপ প্যাকেজ, কাঠের মধ্যে খোদাই করা ছবিসহ নানা উপহার তুলে দেন।

বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সব মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে তিনি নিজের মাকেও স্মরণ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগের ফলে নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বের দরবারে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে।

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক প্রীতি চক্রবর্ত্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গরবিনী মা সম্মাননা প্রদানের প্রধান উদ্যোক্তা চিকিৎসক আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী। প্রীতি চক্রবর্ত্তী ও আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী—এই দুই ভাই–বোন জানান, ২০১৪ সালে তাঁদের মা পুষ্প চক্রবর্ত্তী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী মা ভালো হলে মায়েদের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। মা সুস্থ হলে পারিবারিক উদ্যোগে সেই বছর থেকেই মায়েদের সম্মাননা জানানো শুরু হয়। শুরুতে পাঁচজন গরবিনী মাকে সম্মাননা জানানো হয়। এই দুই ভাই–বোনের মা সুস্থ আছেন এবং তিনিও আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

বক্তব্যে আশীষ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তিনজন সন্তান স্নাতকোত্তর হলে ওই মাকে সম্মাননা দেয়। তবে একজন সন্তানও যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হন, ওই মাকে ‘গরবিনী মা’ হিসেবে সম্মাননা জানানো হচ্ছে। বিনোদনজগতের কোনো শিল্পীর মাকে গরবিনী সম্মাননা পেতে হলে সন্তানকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হতে হবে অথবা একাধিকবার মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কার পেতে হবে।

১০ জন গরবিনী মা: যশোরের জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ শেখ নাজমুল আলমের মা ফিরোজা বেগম; স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান কিডনি প্রতিস্থাপন সার্জন অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলামের মা অধ্যাপক রহিমা খাতুন; প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-২ মো. শহীদুল ইসলামের মা রাবেয়া খাতুন; ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমানের মা সাহেদা রহমান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসিফ হোসেন খানের মা রওশন আরা বেগম; দৈনিক কালবেলার সম্পাদক সন্তোষ শর্মার মা চঞ্চলা রানী শর্মা; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশার মা শাহীন মাহফুজা হক; অভিনেতা ও অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক এম এম কামরুল হাসান রওনকের (রওনক হাসান) মা সামসুন্নাহার মজুমদার; জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ইমরানের মা সেলিনা হক এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক চন্দ্রশেখর চৌহানের মা মিনা চৌহান এবার সম্মাননা পেয়েছেন। এই মায়েদের ফুল দিয়ে ও উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা জানানো হয়।

মাকে নিয়ে সন্তানদের অনুভূতি

মাকে নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, এই পৃথিবীতে আসা এবং এখন পর্যন্ত যতটুকু সুনাম অর্জন করেছেন, সবই সম্ভব হয়েছে মায়ের জন্য। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। এসএসসি পাস করা মা তখন চার সন্তানের মা। তাই মাকে নানিবাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। সেই মা পড়াশোনা করেন, ঢাকায় এসে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন।

অধ্যাপক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘এফসিপিএস না করা পর্যন্ত টাকার পেছনে ছুটতে মা নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কারও কাছে যাতে হাত না পাতি, তা–ও বলে দিয়েছেন। ক্যানসারে এক ভাই মারা যান, মা ভাইয়ের চিকিৎসায় কারও কাছে হাত পাতেননি। জমানো টাকা দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলেন।’

শেখ নাজমুল আলম বললেন, মায়েরা ভালো থাকলে দেশ ভালো থাকে। ৭৬ বছর বয়সী মায়ের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত তিনি যা শিখছেন, তা নিজের সন্তানের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান বলেও জানালেন।

মো. শহীদুল ইসলাম বললেন, সবচেয়ে বড় আশ্রয়ের নাম হচ্ছে মা। ৮০ বছরের বেশি বয়সী মা এখনো পদে পদে তাঁকে গাইডলাইন দিচ্ছেন বলে জানালেন তিনি।

মো. মুনিবুর রহমান বললেন, ‘আমাদের দুই ভাইয়ের যতটুকু অর্জন, তার কৃতিত্ব মায়ের। মা আমাদের জন্য অনেক স্যাক্রিফাইস করেছেন। এই বয়সেও আমি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে আলোচনা করি।’

নুসরাত ইমরোজ তিশা জানালেন, তাঁর মা চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। শুধু তাঁর জন্য ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দেন। তিশা বললেন, ‘আমি এ পর্যন্ত যত অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, সব মায়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। নিজে মা হওয়ার পর বুঝতে পারছি, মায়েদের কতটুকু স্যাক্রিফাইস করতে হয়। মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

চন্দ্রশেখর চৌহান অদম্য মেধাবী হিসেবে প্রথম আলো ট্রাস্ট থেকে বৃত্তি পেয়েছেন। জানালেন, অন্যের জমিতে বসবাস করা বাবা চা–পরোটা বিক্রি করতেন। মা ঠোঙা বানাতেন। প্রথম আলো ট্রাস্ট, ব্র্যাক ব্যাংকসহ এ পর্যন্ত যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। চন্দ্রশেখর চৌহান বলেন, এ পর্যন্ত সরকারসহ সবার কাছ থেকে শুধু নিয়েছেন। এখন মা ও জন্মভূমির জন্য কিছু করতে চান।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা। বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের সিইও কর্নেল মীর মোতাহার হোসেন, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি মো. আমিন হেলালি নিজের মা–সহ অন্য মায়েদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।