ব্রণ ও দাগ: কেন হয়, চিকিৎসা ও করণীয় নিয়ে পরামর্শ

‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত রোববার অনুষ্ঠিত হয়ছবি: প্রথম আলো

ব্রণের জন্য আধুনিক চিকিৎসা যেমন লেজার বা কেমিক্যাল পিলিং খুবই কার্যকর। এগুলোর মাধ্যমে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ব্রণের দাগ কমানো সম্ভব। তবে চিকিৎসা অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এবং সঠিক জায়গা থেকে নিতে হবে। কারণ, যত্রতত্র লেজার সেন্টার বা পারলারে ভুল চিকিৎসা ডেকে আনতে পারে ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি।

‘সুস্থ ত্বকের গল্প’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড অ্যাসথেটিক ডার্মাটোলজিস্ট এবং ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির। প্রথম আলো ডটকম ও এসকেএফ ডার্মাটোলজির যৌথ উদ্যোগে এই অনলাইন আলোচনার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার সুরাইয়া আহমেদ।

ব্রণের সমস্যা নিয়ে অনেকেই ঝামেলায় থাকেন এবং এর চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানা ভ্রান্ত ধারণা ও সতর্কতার অভাব। তাই আলোচনার এ পর্বে ব্রণের বিভিন্ন সমস্যা এবং আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন ডা. শারমিন কবির। পর্বটি গত রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলোজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

ব্যাকটেরিয়াল নাকি ফাঙ্গাল ইনফেকশন?

আলোচনার শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান, ব্রণ আসলে কী ধরনের ইনফেকশন? এটি কি ব্যাকটেরিয়াল নাকি ফাঙ্গাল ইনফেকশন?

উত্তরে ডা. শারমিন কবির বলেন, ব্রণ মূলত একটি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, যা প্রোপ্রিয়নিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেস নামক একধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে হয়। তবে আজকাল ‘ফাঙ্গাল একনি’ বলেও একধরনের ব্রণ হয়ে থাকে। অর্থাৎ এটি ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস উভয় থেকেই হতে পারে। এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের প্রভাবে ত্বকের নিচে থাকা সেবাসিয়াস গ্রন্থি বড় হয়ে যায়, যার ফলে ত্বকে অতিরিক্ত তেল উৎপন্ন হয়ে ব্রণের সৃষ্টি হয়।

ব্রণ কার হয়, কেন হয়

ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে কাদের ব্রণ বেশি হয় এবং কেন হয়? জানতে চাইলে, অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, ‘ব্রণ ছেলে ও মেয়ে সবারই হয়, তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এটি মেয়েদের মধ্যে কিছুটা বেশি দেখা যায়। বয়ঃসন্ধিকালে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন অতিমাত্রায় নিঃসৃত হওয়ার কারণে এই সময়ে ব্রণ বেশি হয়। তবে এটি বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মধ্য বয়স পর্যন্ত যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া খুব গরম ও আর্দ্র। এই আবহাওয়ার সঙ্গে কি ব্রণের কোনো সম্পর্ক রয়েছে? এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, আবহাওয়ার সঙ্গে ব্রণের সম্পর্ক আছে। আমাদের দেশে গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই নিজের ত্বকের ধরন অনুযায়ী প্রতিদিন একটি ভালো ফেসওয়াশ দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করতে হবে এবং ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।

প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানতে চান, তৈলাক্ত ত্বকে কি ব্রণ বেশি হয়?

উত্তরে অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, তৈলাক্ত ত্বকে ব্রণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কারণ, প্রোপ্রিয়নিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনেস তৈলাক্ত ত্বকে বেশি বৃদ্ধি পায়। তবে ব্রণ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দুটো কারণেই হতে পারে। বাহ্যিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ত্বকে বিভিন্ন রং ফরসাকারী ক্রিম এবং স্টেরয়েডজাতীয় ক্রিমের ব্যবহার। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন যেমন রাত জেগে ফোন চালানো বা জাঙ্ক ফুড খাওয়াও ব্রণের প্রবণতা বাড়ায়। আর অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হরমোনজনিত সমস্যা, বিশেষ করে মেয়েদের পিসিওএস (পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম)। এ ছাড়া হাইপারথাইরয়েডিজম, কুশিং সিনড্রোম, অ্যাডেনোমার মতো কিছু রোগের কারণেও ব্রণ হতে পারে। সেই সঙ্গে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস ব্রণের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে তোলে।

অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির আরও বলেন, সবার ত্বকের ধরন আলাদা। অনেক সময় দেখা যায় আমরা না বুঝেই বিভিন্ন ঘরোয়া টোটকা অনুসরণ করে থাকি কিংবা ব্রণ হলে হাত দিয়ে খোঁচাই, যা মোটেও ঠিক নয়। এতে ব্রণ সেরে যাওয়ার পর যে দাগ বা স্কার হয়, যেগুলো সহজে যায় না।

ত্বক সুস্থ রাখতে ব্রণের বিভিন্ন সমস্যা এবং আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির
ছবি: প্রথম আলো

ব্রণ ও ব্রণের দাগের চিকিৎসা কী

ব্রণ এবং ব্রণের দাগ ও স্কারের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, ব্রণ এবং ব্রণের দাগ ও স্কারের চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। ব্রণের চিকিৎসার জন্য প্রথমে রোগীর ইতিহাস নেওয়া হয় এবং হরমোনজনিত সমস্যা আছে কি না, তা দেখা হয়। প্রয়োজনে রক্ত পরীক্ষা ও আলট্রাসনো করা হয়। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য আমরা কিছু উপাদান যেমন বেনজয়েল পার অক্সাইড, স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, গ্লাইকোলিক অ্যাসিড, ট্রেটিনয়েন বা অ্যাডাপলিন ব্যবহার করতে বলি। যদি ব্রণ খুব বেশি হয়, তাহলে ডক্সিসাইক্লিন, ইরিথ্রোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিনের মতো কিছু অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। যদি এতেও কাজ না হয়, তাহলে রেটিনয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়।’

ডা. শারমিন কবির বলেন, ব্রণের দাগের জন্য আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে কেমিক্যাল পিলিং এবং স্কারের জন্য ফেস পিআরপি, মাইক্রোনিডলিং, সাবসিশন, ফ্র্যাকশনাল সিওটু লেজার ইত্যাদি করা হয়।

কিছু ভুল ধারণা

লেজার এবং কেমিক্যাল পিলিংয়ের মতো আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে অনেকের ভুল ধারণা আছে। অনেকেই ভাবে এগুলো ক্ষতিকর বা অনেক ব্যয়বহুল। এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো নিয়ে অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, লেজার নিয়ে একটি সাধারণ ভুল ধারণা আছে যে এটি করলে ক্যানসার হয়। কিন্তু এটি একদমই ভুল। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে লেজার বা অন্যান্য চিকিৎসা করালে চমৎকার ফল পাওয়া যায়।

শারমিন কবির বলেন, এখন ডার্মাটোলজি অনেক উন্নত হয়েছে, বিশেষ করে সৌন্দর্য সম্পর্কিত দিকগুলোতে। কেমিক্যাল পিলিংয়ের মাধ্যমে ত্বকের ওপরের মৃত স্তরটি তুলে ফেলা হয়, যা ব্রণ ও দাগ কমাতে সাহায্য করে। এই চিকিৎসাগুলো এখন হাতের নাগালে এবং আগের চেয়ে বেশ সাশ্রয়ী।

করণীয় কী

সময়মতো চিকিৎসা না নিলে ব্রণ থেকে কী ধরনের জটিলতা হতে পারে? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, সময়মতো চিকিৎসা না নিলে ব্রণ-পরবর্তী জটিলতা যেমন পোস্ট-ইনফ্ল্যামেটরি হাইপারপিগমেন্টেশন (দাগ), স্কার, ফলিকুলাইটিস এবং কিলয়েড (ফোলা, শক্ত দাগ) হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দীর্ঘদিন ধরে ব্রণ থাকলে রোগী মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং বিষণ্নতায় ভুগতে পারে। তাই সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া খুবই জরুরি।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে অধ্যাপক ডা. শারমিন কবির বলেন, ব্রণ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন বজায় রাখতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুমানো, প্রচুর পানি পান করা এবং শাকসবজি ও ফল খাওয়া খুব জরুরি। বাইরের জাঙ্ক ফুড এবং তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে প্রতিদিন একটি ভালো ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে হবে। যদি একটি রুটিনের মধ্যে চলা যায়, তাহলে ব্রণের সমস্যা খুব একটা দেখা যায় না।