শতবর্ষী স্টিমারে কীভাবে চড়বেন, খরচ কত
অপেক্ষার পালা শেষ। প্রায় তিন বছর পর আবার জলে ভাসবে পি এস মাহসুদ। ঢাকা–বরিশাল নৌপথে চলার জন্য শতবর্ষী এই স্টিমারটি সংস্কার করা হয়েছে। ১৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ২১ নভেম্বর শুরু হবে চলাচল।
এক সময় ঢাকার সদরঘাট থেকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত স্টিমার চলাচল করত। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রীর অভাবে ২০২২ সালে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিন বছর ধরে অচল থাকা মাহসুদকে নতুন রূপে সাজায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে এক দিন ঢাকা থেকে বরিশাল যাবে স্টিমারটি। প্রতি শুক্রবার সকাল ৮টায় ঢাকার সদরঘাট থেকে ছাড়বে, বরিশাল পৌঁছবে রাতে। আগে স্টিমার চলাচল করত রাতে। কিন্তু এবার দিনে স্টিমার চালু করায় নদী ও তীরের দৃশ্য উপভোগে মানুষ আগ্রহী হবে বলে আশা করছেন বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা।
সম্প্রতি স্টিমারটির ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে পরীক্ষামূলক যাত্রা শেষে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘পি এস মাহসুদ কেবল একটি নৌযান নয়, এটি বাংলাদেশের নদীজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রতীক। আমরা চাই, নতুন প্রজন্ম কাছ থেকে দেখুক, একসময় নদীপথই ছিল যোগাযোগ ও সংস্কৃতির প্রাণ।’
স্টিমার চলা তো শুরু হচ্ছে, কিন্তু এতে একসঙ্গে কত যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবে, ভাড়া কেমন পড়বে, টিকিট কীভাবে পাওয়া যাবে, তা নিয়ে রয়েছে অনেকের কৌতূহল। এই প্রতিবেদন তাদেরই জন্য।
কতজন যেতে পারবে
বর্তমানে ঢাকা-বরিশাল রুটে অনেক বিলাসবহুল লঞ্চ চলালচল করে। লঞ্চগুলো তিন-চারতলা হয়ে থাকে। তবে শতবর্ষী স্টিমার দোতলা। এ কারণে বেশি যাত্রী একসঙ্গে স্টিমারে ভ্রমণ করতে পারবেন না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিবার ১০০ থেকে ১৫০ যাত্রী স্টিমারে ভ্রমণ করতে পারবেন।
স্টিমারে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য তিনটি ক্যাটাগরি থাকবে। প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেণির কেবিন। এই কেবিনে দুটি শয্যা থাকবে। সেখানে দুজন অনায়াসে ভ্রমণ করা যাবে। প্রতিটি কেবিনের বাইরে চেয়ার পাতা থাকে। সেখানে বসে নদীপথের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে।
দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতেও কেবিন সুবিধা রয়েছে। তবে সেটি দ্বিতীয় শ্রেণির। এটি অবশ্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নয়। এখানেও দুটি করে শয্যা থাকবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২২টি কেবিন রয়েছে স্টিমারে। প্রতিটি কেবিনে দুজন করে যাত্রী থাকলে মোট ৪৪ জন যাত্রী কেবিনে ভ্রমণ করতে পারবেন।
এ ছাড়া স্টিমারের দোতলার মাঝখানের জায়গা তৃতীয় ক্যাটাগরির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হবে। এখানে যাত্রীদের বসার জন্য চেয়ার থাকবে। তবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থাকবে না। এখানে ৫০ জনের মতো যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবেন।
ভাড়া কেমন
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রথম শ্রেণির কেবিন ভাড়া সবচেয়ে বেশি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিসির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কেবিনের ভাড়া এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে প্রাথমিকভাবে প্রথম শ্রেণির কেবিনের ভাড়া ৬ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ দুজন গেলে মাথাপিছু ৩ হাজার টাকা খরচ হবে সারা দিনের জন্য।
দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ এই কেবিনের যাত্রীকে মাথাপিছু ২২০০ টাকার কিছু বেশি খরচ করতে হবে।
আর চেয়ারে বসে যেতে চাইলে প্রতি যাত্রীকে ২ হাজার টাকা খরচ করা লাগতে পারে।
বিআইডব্লিউটিসির ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ভ্রমণের খরচের মধ্যে যাত্রীদের জন্য কমপ্লিমেন্টারি নাশতার ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরুর পরপরই শুরু হবে নাশতা পর্ব।
বুকিং কীভাবে
বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, স্টিমার পরিচালনার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে নৌ-পর্যটনে অভিজ্ঞতা আছে এমন কাউকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তবে টিকিট বুকিং ও খাবারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নৌ-পর্যটনে অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ট্যুর অপারেটরদের প্রাধান্য দেওয়া হবে। চূড়ান্ত হলে তারাই টিকিট বুকিং ও যাত্রী পরিষেবার দায়িত্ব পালন করবে।
ঢাকা, বরিশাল ও চাঁদপুরের বিআইডব্লিউসি অফিস থেকে যাত্রীরা টিকিট বুকিং দিতে পারবেন। এ ছাড়া সহজ ডটকম থেকে অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা থাকবে।
খাবারদাবার
পি এস মাহসুদে ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত ভ্রমণের সময় আরোহীরা উপভোগ করতে পারবেন ঐতিহ্যবাহী খাবার—ফিশ কাটলেট, স্মোকড হিলশা ও ফিশ ফ্রাই। বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা। খাবার খেতে খেতে মন ঘুরে আসতে পারে পুরোনো সেই দিনগুলোয়।
এ ছাড়া যাত্রীদের জন্য নিচতলায় থাকবে একটি জুসবার। সেখানে বসে পছন্দের জুস কিংবা কোমল পানীয়তে চুমুক দিয়ে নদীভ্রমণ উপভোগ করা যাবে।
বিনোদন
অনেকেই পরিবার–পরিজন নিয়ে ভ্রমণ করেন। সেই কথা মাথায় রেখে স্টিমারের অন্দর মহলের সাজসজ্জায়ও আনা হয়েছে পরিবর্তন। দীর্ঘ যাত্রায় শিশুরা যেন বিরক্তি বোধ না করে সে জন্য নিচতলায় তাদের জন্য জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নদীতে ভেসে ভেসে বরিশাল যাওয়ার সময় শিশুরা ‘কিডস জোন’–এ সময় কাটাতে পারবে। সেখানে কিছু রাইড রাখা হয়েছে। সেখানে হইহুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারবে তারা।
এ ছাড়া নিচতলায় ছোট একটি মঞ্চ রাখা হয়েছে। যেখানে লাইভ মিউজিক শোনার ব্যবস্থা থাকবে। চাইলে কেউ নিজেও মঞ্চে মাইক হাতে গান গেয়ে শোনাতে পারবেন।
রাতে থাকার ব্যবস্থা
ঢাকা থেকে ছেড়ে বরিশাল পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। পরদিন সকালে আবার ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসবে। কেউ স্টিমারে রাত কাটাতে চাইলে সে ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। তবে এ জন্য খরচ কত হবে, তা চূড়ান্ত হয়নি।
যাত্রীরা চাইলে কেবিন ভাড়া করে বিশ্রাম নিতে পারবেন। এরপর রাতে বরিশাল শহর ও এর আশপাশের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করে স্টিমারে থাকতে পারবেন। পরদিন সকালে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে পারবেন।
থাকবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ছোঁয়া
স্টিমারের সঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সম্পর্ক রয়েছে। জড়িয়ে আছে কয়েক প্রজন্মের গল্প। ব্রিটিশ আমল, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ, এরপর পাকিস্তান আমল, তারপর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।
ভ্রমণের সময় যাত্রীদের সেই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ জন্য স্টিমারের নিচতলায় যুক্ত করা হয়েছে ‘হেরিটেজ কর্নার’। সেখানে দেখা যাবে শতবর্ষে প্যাডেল স্টিমারে ভ্রমণ করা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের স্মৃতি, পুরোনো নেভিগেশন যন্ত্রপাতি, প্রাচীন নকশা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। যেন একসঙ্গে ইতিহাস, স্মৃতি ও নদীভ্রমণের আনন্দ।
একসময় বাঙালির চলাচলের প্রধান পথ ছিল নদী। এখন সড়ক, রেল আর আকাশপথে দ্রুতগতির চলাচলে অভ্যস্ত হয়েছে মানুষ। সেখানে পি এস মাহসুদ যেন সেই হারিয়ে যাওয়া নৌ চলাচলের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
কালের সাক্ষী পি এস মাহসুদ
ব্রিটিশ আমলে ১৯২২ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপে নির্মিত হয় পি এস মাহসুদ। বেলজিয়ামের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮৩ সালে নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ লিমিটেডের মাধ্যমে স্টিমারটির স্টিম ইঞ্জিনকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালে এটিকে মেকানিক্যাল গিয়ার সিস্টেমে রূপান্তর করা হয়।
২০২২ সালে চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে একে আবার চলাচল উপযোগী করা হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিসি জানায়।