এক দিনে ১৩ গাড়িতে আগুন

দ্বিতীয় দফার অবরোধের প্রথম দিনে ঢাকায় বাসচালক অগ্নিদগ্ধ, পুলিশের গাড়িতে ককটেল হামলা। বগুড়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ।

বিএনপির দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন গতকাল সন্ধ্যায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা বাংলামোটর মোড়ে
ছবি: সজীব মিয়া

পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির কঠোর নিরাপত্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ‘সতর্ক পাহারার’ মধ্যেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ডাকা দ্বিতীয় দফার অবরোধের প্রথম দিনেই গতকাল রোববার ভোর ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সারা দেশে ১৩টি গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এর মধ্যে শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ৮টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এর বাইরে গাজীপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও খাগড়াছড়ি—এই পাঁচ জেলায়ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যানবাহনে আগুন দেওয়ার বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে সন্ধ্যার পর এবং ভোরে।

বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি গতকাল রাজধানীর উত্তরায় পুলিশের গাড়িতে ককটেল হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এতে পুলিশের তিনজন সদস্য আহত হয়েছেন। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গত শনিবার মধ্যরাতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

অবরোধের প্রথম দিন ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস খুব একটা ছেড়ে যায়নি। ঢাকার ভেতরে গণপরিবহন চলেছে তুলনামূলক কম।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার ঘটনায় দলটি ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয়। হরতালের পরদিন কোনো কর্মসূচি ছিল না দলটির। এরপর ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এরপর দুই দিন বিরতি দিয়ে গতকাল রোববার থেকে আবার দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। একই ধরনের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন জোট ও দল।

অবরোধের মধ্যে একের পর এক যানবাহনে আগুন-ভাঙচুরের ঘটনায় জনমনে শঙ্কা তৈরি করেছে। যদিও পুলিশ বলছে, অবরোধের মধ্যে নাশকতা ঠেকাতে ঢাকাসহ দেশজুড়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অন্যদিকে র‌্যাব বলছে, অবরোধে দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৩০০ টহল দল কাজ করেছে। ঢাকায় রয়েছে ৭০টি টহল দল। সাধারণত র‌্যাবের প্রতি টহল দলে কাজ করেন ৮-১০ জন সদস্য। সঙ্গে একটি গাড়ি থাকে।

র‌্যাবের পাশাপাশি নাশকতা ঠেকাতে কাজ করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এই বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঢাকা ও আশপাশের জেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২৭ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

অবরোধের আগের দিন গত শনিবার রাতেও সারা দেশে ৬টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকায় ৪টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। অর্থাৎ দ্বিতীয় দফার অবরোধকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারা দেশে গত শনিবার রাত থেকে গতকাল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মোট ১৯টি গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

অবরোধে সড়ক-মহাসড়কে পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে গতকাল বিকেলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তিনি বলেন, যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। অবরোধ চলাকালে মহাসড়কে যানবাহনের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাসচালক অগ্নিদগ্ধ

প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম দফায় অবরোধের তিন দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে ৩০ গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আর দ্বিতীয় দফার অবরোধকে কেন্দ্র করে শনিবার রাত থেকে গতকাল রাত পর্যন্ত ১৯টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সূত্র বলছে, গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। বাসটি যাত্রী নিয়ে গাবতলী থেকে ডেমরা যাচ্ছিল। পথে বাঁশপট্টি এলাকায় যাত্রী ওঠানামার জন্য থামলে এ ঘটনা ঘটে। এতে বাসচালক মো. সবুজ (৩০) অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তাঁর শরীরের শ্বাসনালিসহ ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাঁকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ভোর ৪টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ঢাকায় ৮টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকার ডেমরা ও শ্যামপুরে রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা দুটি বাসে ভোর ৪টার দিকে আগুন দেওয়া হয়। খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ায় দুর্বৃত্তরা বাসে আগুন দেয় সকালে। মিরপুরে সকাল-দুপুর ও সন্ধ্যায় তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আর সন্ধ্যায় বাংলামোটরে বাসে এবং রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিউমার্কেট এলাকায় একটি কারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

এ ছাড়া ঢাকার বাইরে গতকাল সিলেটে পণ্যবাহী পিকআপে, গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি কাভার্ড ভ্যানে, খাগড়াছড়ির আলুটিলা জিরোমাইল এলাকায় ট্রাকে এবং চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকায় একটি মিনিবাসে এবং খুলনার রূপসা এলাকায় একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা অবরোধকে কেন্দ্র করে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে চাপে ফেলতে অন্য কেউ অগ্নিসংযোগ করে বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে।

গণপরিবহনে আগুন লাগার ঘটনায় পুলিশ জড়িত বলে দাবি করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল রাতে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ নিজেরাই আগুন লাগিয়ে বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে। অনেক চালক স্বীকার করেছেন, পুলিশের উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন পরিবহনে আগুন লাগাচ্ছে।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে তালা

ছাত্রদলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অবরোধের সমর্থনে গতকাল তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের ৯টি ফটকে তালা দিয়েছে। একই সঙ্গে ছাত্রদলের ব্যানারও লাগানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

পরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মচারীরা এসব তালা ভেঙে ফেলেন।

এ ছাড়া গতকাল সকাল ৭টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সাতটি ফটকে তালা দেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। সকাল আটটার পর পাঁচটি ফটকের তালা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ভেঙে ফেলেন। আর বাকি দুটি ফটকের তালা ভাঙে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অবরোধের প্রথম দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেছেন। অবশ্য তাঁরা প্রকাশ্যে এসে বেশি সময় নিয়ে কোনো কর্মসূচি পালন করছেন না। বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা মিছিল করে আবার আড়ালে চলে যাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যার পর বনশ্রী এলাকায় মশাল মিছিল করেছে ছাত্রদল। ফকিরাপুরে মশাল মিছিল করেছে স্বেচ্ছাসেবক দল। সূত্রাপুর, মতিঝিল, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাংলামোটর, মালিবাগসহ কয়েকটি এলাকায় অবরোধের সমর্থনে মিছিল করেছে বিএনপি।

যাত্রী নেই, তাই দূরপাল্লার বাস ছাড়েনি

গতকাল সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রী নেই বললেই চলে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টার্মিনালে ময়মনসিংহগামী সৌখিন পরিবহনের একটি বাসের কর্মীদের যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সৌখিন পরিবহনের বাসচালক মনির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অন্যদিন এই সময়ে শুধু সৌখিন পরিবহনেরই অন্তত ২০টি গাড়ি ময়মনসিংহের উদ্দেশে ছেড়ে যেত। আজ (গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা) একটিও ছেড়ে যায়নি।

মহাখালী বাস টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল এই টার্মিনাল থেকে এনা পরিবহনের বাসগুলো ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। অন্য পরিবহনের বাস খুবই কম চলেছে। এনা পরিবহনের টিকিট কাউন্টারের কর্মী অন্তর বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রী একেবারেই ছিল না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩০টি বাস ছেড়ে গেছে। এই সময়ে অন্য দিন ৬৫ থেকে ৭০টি বাস ছেড়ে যায়।

মহাখালী বাস টার্মিনালে কথা হয় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেউ যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে, সে জন্য তাঁরা সতর্ক।

রেলপথ ও সড়কপথে অবরোধ

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, বগুড়া শহরতলির প্রথম বাইপাসের তেলিপুকুর এলাকায় গতকাল সকালে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এ সময় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। সংঘর্ষে পুলিশের ৩ সদস্যসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।

এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুই থেকে আড়াই শ যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে পাবনার ঈশ্বরদী রেলগেট এলাকায় কাগজ ও টায়ারে আগুন লাগিয়ে অবরোধ করেন। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল সেখানে হাজির হয়। পুলিশের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছামাত্র ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণ ও দুটি গুলির শব্দ পাওয়া যায়। ককটেলের বিস্ফোরণে পুলিশের গাড়ির কাচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, জড়িতদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।

অবরোধের সমর্থনে গতকাল সিলেট শহরের লালাবাজার এলাকা, ফেনীর সোনাগাজী ও ফরিদপুর সদর উপজেলার মুন্সির বাজার এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা রাস্তায় অবস্থান নেন। পরে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়।

পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির তৎপরতার মধ্যেও গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না—এমন প্রশ্নে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, যারা অবরোধের সমর্থক, তারাই অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে, তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক পরিচয় আছে এমন ব্যক্তিরা যাত্রীর বেশে বাসে উঠে নাশকতা করছে, কখনো চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক না থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক বেশি ঘটত।