খামারে মুরগির রোগনিয়ন্ত্রণে জৈব নিরাপত্তাব্যবস্থায় সাফল্য এসেছে
ছবি: সংগৃহীত

খামারে মুরগির রোগনিয়ন্ত্রণে জৈব নিরাপত্তাব্যবস্থা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পরিবর্তন এসেছে খামার স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায়। বেড়েছে রোগনিয়ন্ত্রণ সচেতনতা। অধিকতর গুরুত্ব বেড়েছে অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত মানসম্পন্ন মুরগি উৎপাদনে। ফলে কম খরচে বেশি উৎপাদনের সুফল পেতে শুরু করেছেন খামারিরা।

এসব অর্জনের অগ্রভাগে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক বা কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ে খামার পরিচালনা। সব মিলিয়ে জনস্বাস্থ্যের জটিল সমস্যা মোকাবিলায় দেশের পোলট্রি খাত ব্যাপক সাংস্কৃতিক রূপান্তরপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বলে মতামত দিয়েছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনায় বড় কোম্পানির প্রশিক্ষিত কর্মীরা পোলট্রি খামারিদের উন্নত চাষ-সংস্কৃতি গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁরা পোলট্রি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে খামার স্থাপনে প্রান্তিক চাষিদের কারিগরি দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। খামারে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষতিকর অনুশীলনের পরিবর্তে জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখতে উৎসাহিত করছেন প্রশিক্ষিত কর্মীরা।

কোম্পানির উদ্যোগে খামারের দোরগোড়ায় সব সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এতে আধুনিক শিল্পজ্ঞানলব্ধ উন্নত খামার ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষিত খামারিদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতাও বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অধিকতর গুরুত্বে আলোচিত বিষয়টি মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা জানাতে সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশি পোলট্রিশিল্প বিকাশমান রাজশাহী এলাকার বিভিন্ন খামার।

খামারিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এ খাতের সমস্যা ও সম্ভাবনার হরেক রকমের তথ্য ও চিত্র। জেলার পবা উপজেলার দুই খামারি জুয়েল রানা ও সাব্বির আহমেদ। পুরোনো ভাবকিতে জুয়েল এবং মধুপুরে সাব্বিরের মুরগির খামার। ডিলারের সঙ্গে খামার করার দুঃখগাথা পেছনে ফেলে দুজনই যুক্ত হয়েছেন কাজী ফার্মেসের জৈব নিরাপত্তামূলক কনট্রাক্ট ফার্মিংয়ে। কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে ২৯ বছর বয়সী যুবক জুয়েল রানা নিজ বাড়ির অদূরে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক এক শেডে ১ হাজার ৮০০ মুরগি উৎপাদন করে ৬৭ হাজার টাকা আয় করেছেন। বর্তমানে চলছে ১৯তম ব্যাচ। এরই মধ্যে লাভের টাকায় গড়েছেন আরও একটি শেড। নিজের এই সফলতার নেপথ্যে কাজী ফার্মসের কর্মীদের সহযোগিতাকে বড় কারণ হিসেবে তুলে ধরলেন জুয়েল।

জুয়েল রানা বলেন, ‘খামারে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় রোগবালাই নেই বললেই চলে। ফলে লাগছে না বাড়তি কোনো ওষুধ। ন্যূনতম অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই মুরগির গড় ওজন হচ্ছে ২ কেজি ৪০০ গ্রাম । খামারের আয়ে সংসার খরচ মিটিয়ে জমানো টাকায় উন্নত জাতের একটি গরুও কিনেছি।’ জুয়েলের সাফ কথা, ‘যত দিন কনট্রাক্ট ফার্মিং থাকবে, তত দিন মুরগির খামারই করব।’

খামারে মুরগির রোগনিয়ন্ত্রণে জৈব নিরাপত্তাব্যবস্থায় সাফল্য এসেছে
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় অভিন্ন অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে মধ্যবয়সী সাব্বির আহমেদ জানান, কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী খামার পরিচালনায় বাধ্যতামূলক নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ মুরগি চাষে সুদিন এসেছে। খামারে নির্ধারিত নিয়মে লিটার, খাবার ও পানি ব্যবস্থাপনায় মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। পরিমিত খাবারে আশাতীত ওজন বাড়ে। খামারের চারপাশে দেওয়া নিরাপত্তাবলয়ের কারণে ছোঁয়াচে বা ভাইরাসজনিত কোনো রোগের সংক্রমণ না থাকায় মুরগির মৃত্যুর হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

একইভাবে চারঘাটের কালাবাড়িয়ায় লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে জৈব নিরাপত্তায় নির্মিত আধুনিক খামারের সামনে দাঁড়িয়ে এ খাতের উন্নয়নে কাজী ফার্মসের অবদানের কথা তুলে ধরেন মধ্যবয়সী খামারি আবদুল্লাহ আল রাজিব। তিনি জানান, ‘যথোপযুক্ত জ্ঞান ও পরামর্শের অভাবে আগে মড়ক লেগে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে যেত, চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনা সেই দুঃসময়ের অবসান ঘটিয়েছে। এ ক্ষেত্রে খামারকে সব রকম পোকামাকড় থেকে রক্ষা করতে চারপাশের গাছের ডাল, আগাছা ও ঘাস নিয়মমাফিক ছেঁটে ফেলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে চুক্তিতে।’ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা সত্ত্বেও খামারে ২ শতাংশের মতো মুরগি মারা যায়, যা এ অঞ্চলের অতি তপ্ত আবহাওয়া বা প্রকৃতির বৈরিতার কারণ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

চুক্তিভিত্তিক খামার পরিচালনায় খামারিদের সাফল্যের নেপথ্যে কাজ করা কাজী ফার্মসের তারুণ্যদীপ্ত আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মো. সুমন আলী শাহ জানান, শতভাগ খামারে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে মধ্যস্বত্বভোগীমুক্ত হবে মুরগির বাজার। খামারিদের আর্থিক সচ্ছলতা আরও বাড়বে। ভোক্তা পাবেন সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত মুরগির মাংস। খামারকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান বাড়বে, চাকরিমুখী চাপ কমবে। তাঁর হিসাবে, রাজশাহী অঞ্চলের ৬০ শতাংশ খামার এখন জৈব নিরাপত্তাব্যবস্থার আওতায় এসেছে। সুফল বিবেচনায় অন্যরাও আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এ কাতারে শামিল হবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন সুমন আলী।

মুরগির খামারের জৈব নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান সিকদার বলেন, এ ব্যবস্থায় খামারের কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর নিয়মাচার অনুসরণের কারণে রোগবালাই আক্রমণের শঙ্কা থাকে না। পক্ষান্তরে, এককেন্দ্রিক ব্যক্তিপর্যায়ের খামারে জৈব নিরাপত্তা উপেক্ষিত হওয়ায় বিশেষজ্ঞবহির্ভূত পরামর্শে ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর জোর দেওয়া হয়। মুরগির খামারে অ্যান্টিবায়োটিকে অবাঞ্ছিত ব্যবহারের প্রভাব পড়ে মানবদেহে। ফলে মানবদেহের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অকার্যকর করে ফেলে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে চুক্তিভিত্তিক খামারিদের জৈব নিরাপত্তা অনুসরণে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ বড় সফলতার পথ দেখাচ্ছে।