শরীরে আগুন নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছিলেন তিনজন

স্ত্রী–সন্তানের সঙ্গে আশীষ চন্দ্র সরকার। আগুনে দগ্ধ হয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় তিনজনই এখন হাসপাতালে
ছবি: সংগৃহীত

পরিবারের সদস্যই তিনজন। স্বামী, স্ত্রী ও শিশুপুত্র। তিনজনেরই অবস্থা সংকটাপন্ন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার বিস্তারিত স্বজনদের বলার মতো অবস্থায় নেই তাঁরা। শুধু এটুকু বলতে পেরেছেন, দরজা-জানালা বন্ধ ছিল। ভাত রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই দুই কক্ষের বাসার পুরোটায় আগুন ধরে যায়।

প্রতিবেশীরা স্বজনদের বলেছেন, চিৎকার শুনে তাঁরা গিয়ে দেখেন, শরীরে আগুন নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছেন তিনজন। কাপড় জড়িয়ে দিয়ে সেই আগুন নেভান তাঁরা।

গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফেনী শহরে শহীদ শহীদুল্লা কায়সার সড়কে ইতালি ভবন-২–এর পঞ্চম তলায় ওই ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হন আশীষ চন্দ্র সরকার (৪১), তাঁর স্ত্রী টুম্পা রানী সরকার (৩০) এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান রিক সরকার (৯)। তিনজনকেই মঙ্গলবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়।

স্বজনেরা চুলার গ্যাস থেকে আগুন লাগার কথা বললেও মঙ্গলবার ফেনীর ফায়ার সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা আবদুল মজিদ বলেছিলেন, রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসর বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগেছে। তবে আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রাথমিক ধারণা থেকে কম্প্রেসর বিস্ফোরণ বলে মনে হয়েছিল। তবে চুলার গ্যাস থেকেও এটা হয়ে থাকতে পারে। সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।

আজ বুধবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, শিশু রিককে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মুখমণ্ডলসহ তাঁর প্রায় পুরো শরীর দগ্ধ। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিশুটির চাচা পরিতোষ চন্দ্র সরকার। তিনি জানান, রিক ফেনীতে একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তিনজনের অবস্থাই সংকটাপন্ন বলে চিকিৎসকেরা তাঁদের জানিয়েছেন। তিনজনই গুরুতর দগ্ধ হওয়ার বিষয়ে তাঁরা বিস্তারিতভাবে জানতে পারছেন না।

পরিতোষ সরকার বলেন, ‘দাদা-বউদি বললেন, ম্যাচের (দিয়াশলাই) কাঠি দিয়ে গ্যাসের চুলা জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে আগুন একদম ঘরের ছাদ পর্যন্ত উঠে যায়। দুই কক্ষের পুরো বাড়িতে আগুন লেগে যায়। ওরাই চিৎকার করতে করতে দরজা খুলে বের হন।’ বাকিটা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনেছেন বলে জানান। অন্য ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা তাঁদের (পরিতোষ) বলেছেন, শরীরে আগুন ধরা অবস্থায় তিনজন সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছিলেন। তাঁরা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে আগুন নিভিয়ে কাছের হাসপাতালে নিয়ে যান ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন।

পরিতোষ বলেন, এখন ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে বলবে, আসলে কী হয়েছে। ফ্রিজের কম্প্রেসর থেকে আগুন লাগার কথা তাঁরা শোনেননি। তাঁরা শুনেছেন, তিন দিন আগে ওই ভবনের তিতাস গ্যাসের সংযোগ মেরামতের কাজ করা হয়েছিল।

পরিতোষ সরকার বলেন, তাঁদের পরিবারের সবাই ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় থাকেন। আশীষ সরকার চাকরির কারণে ফেনীতে থাকেন। তিনি ভোর সাড়ে চারটায় ধোবাউড়া থেকে ঢাকায় হাসপাতালে আসেন। তিনি বলেন, ‘দাদা-বউদি আমাকে বলেছেন, বাসার দরজা-জানালা সব সারা দিন বন্ধ ছিল। রাতে দাদা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর বউদি ভাত রান্নার জন্য চুলা জ্বালাতে যান। চুলা জ্বালানোর পরপরই সারা ঘরে আগুন লেগে যায়।’

কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন পরিতোষ। তিনি জানান, তিন ভাই এক বোনের মধ্যে আশীষ সরকার সবার বড়। তিনি ফেনীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষণ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তাঁর মা–বাবা বেঁচে আছেন। তাঁদের এ অবস্থার কথা জানানো হয়নি।

ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির বাবার শরীরের ৮২ শতাংশ, মায়ের ৬০ শতাংশের বেশি এবং শিশুটি ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। শিশুটিকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছে। আর তার মা–বাবাকে হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনজনের অবস্থাই সংকটাপন্ন।