৪৭ বছর পর দুই বোনের দেখা

সম্প্রতি কলকাতায় মায়া রানি বণিক (ডানে) ও বিউটি রানি বণিকের দেখা হয়
ছবি: সংগৃহীত

মায়া রানি বণিক ও বিউটি রানি বণিক দুই বোন। পারিবারিক নানা টানাপোড়েনে ৪৭ বছর আগে দুই বোন আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন।

মায়া চলে যান ভারতের কলকাতায়। বিউটি থেকে যান বাংলাদেশে। গ্রামের লোকমুখের একটা কথা আছে: ‘গাঙে গাঙে দেখা হয়, তবু বোনে বোনে দেখা হয় না’। এই কথা দুই বোন মায়া-বিউটির জীবনে প্রায় সত্য হয়ে গিয়েছিল।

তবে অবশেষে গত সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় দুই বোনের দেখা হয়। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা দুই বোন একসঙ্গে থাকার সুযোগ পান। এই সময়টুকুতে তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন, কান্নাকাটি করে দীর্ঘ ৪৭ বছরের বিচ্ছেদের যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করেন।

দুই বোনের দেখা হওয়ার গল্পটি নিয়ে গত ১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন বিউটির বড় ছেলে মানিক বণিক।

মানিক জানান, তাঁর মাসি মায়ার বয়স কম করে হলেও ৭৫ বছর হবে। আর তাঁর মা বিউটির বয়স ৫৭ বছর। মায়ার স্মৃতি অনুযায়ী, তিনি ১৯৭৬ সালে দেশ ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। মায়া যখন চলে যান, তখন তিনি বয়সে তরুণী। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়েছিল। ছয় মাসের মতো সংসার করেছিলেন তিনি। আর সে সময় বিউটি ছিলেন কিশোরী।

সম্প্রতি রাজধানীর বছিলায় বিউটির বাসার ছাদে বসে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘দুই বোনের তো ম্যালা গল্প। শুরু করলে আর শেষ হবে না। এই জীবনে দুই বোনের আবার দেখা হবে, সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তাই মনে মনে চাইতাম, পরজনমেও বোন (মায়া) যেন বোন হয়েই জন্মায়।’

কলকাতার কেষ্টপুরে মায়ার বাড়িতে প্রায় ৪৭ বছর পর দুই বোনের দেখা হয়। দেখা হওয়ার মুহূর্তটির কথা জানিয়ে বিউটি বলেন, ‘কত কথা যে দুই বোনের মনের মধ্যে জমা ছিল!’

মায়া রানি বণিক (ডানে) ও বিউটি রানি বণিক
ছবি: সংগৃহীত

বিউটির বড় ছেলে মানিক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকেই তাঁর মায়ের মুখে পরিবারের নানা গল্প শুনে এসেছেন। তাঁর মায়ের বাবার জমিদারি ছিল, তাঁর মায়ের বড় বোন হারিয়ে গেছেন—এমন সব গল্প। তাঁর মায়ের জন্মভিটা মাদারীপুরের টেকেরহাট। আগে কখনো সেখানে তাঁর (মানিক) যাওয়ার সুযোগ হয়নি। গত মে মাসে তিনি তাঁর মাকে নিয়ে টেকেরহাটের ‘রায় বাড়ি’ যান।

মানিক বলেন, ‘ফেসবুক মেসেঞ্জারে আমাদের বণিকদের একটি গ্রুপ আছে। গ্রুপে একসময়ের জমিদার বাড়ি বা রায় বাড়ির ছবি পোস্ট করি। গ্রুপে মাসির (মায়া) ছেলেও আছেন। কিন্তু মানিক তা জানতেন না। এদিকে, মাসির ছেলেও তো রায়বাড়ির গল্প শুনে বড় হয়েছেন। তিনি ছবিগুলো তাঁর মাকে (মায়া) দেখান। ছবি দেখেই মাসি বলেন, এ তো তাঁর জন্মভিটা। তারপর আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হতে থাকে।’

ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট মানিক জানালেন, মেসেঞ্জার গ্রুপের সূত্র ধরে যোগাযোগের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে তিনি কলকাতায় গিয়ে তাঁর মাসির সঙ্গে দেখা করেন। আর এবার তিনি তাঁর মাকে নিয়ে ভারতে তীর্থে যান। এই সুবাদে তিনি মাকে তাঁর বোনের সঙ্গে দেখা করিয়ে আনেন। তবে দুই বোন একসঙ্গে থাকার জন্য সময় পেয়েছেন মাত্র কয়েক ঘণ্টা।

দুই বোনকে এত বছর পর দেখা করিয়ে দিতে পারার মুহূর্তটি সম্পর্কে মানিক বলেন, ‘এই অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। দুজনের মনে কত যে গল্প জমে ছিল। দুজনের দেখা হওয়ার মুহূর্তটি ভিডিও করতে ভুলে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য দুই বোনের কয়েকটি ছবি তুলে রাখি।’

পারিবারিক টানাপোড়েনের গল্প

গল্পের শুরুতেই বিউটি ফিরে গেলেন তাঁর ছেলেবেলায়। তিনি জানালেন, তাঁর বাবা হরিপদ বণিকের জমিদারি ছিল। তাঁর অনেক সম্পত্তি ছিল। রায় বাড়িতে মহা আয়োজনে দুর্গাপূজা হতো।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হরিপদ পরিবার নিয়ে কলকাতায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ফিরে এসে দেখেন, রায় বাড়ি প্রায় দখল হয়ে গেছে। একসময় রায় বাড়ির নাম পাল্টে ‘পাল বাড়ি’ হয়ে যায়।

হরিপদের দুই মেয়ে ও তিন ছেলে। দেশে ফেরার পর নিজেদের বাড়ি দখল হয়ে যাওয়া দেখে হরিপদের স্ত্রী বীণা রানি বণিক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বিউটি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দালানকোঠা বেদখল হয়ে গেল। পরে টিন দিয়ে ঘর তুলে নিজেদের জমিরই এক কোণে আমরা থাকতাম।’

হরিপদ মারা যান ১৯৭৫ সালে। তাঁর মৃত্যুর পর বীণাকে খুলনা নিয়ে যান বড় ছেলে। আর বীণা মারা যান ২০০৭ সালে।

মাদারীপুরের টেকেরহাটের জন্মভিটায় বিউটি রানি বণিক (মাঝে)

বিউটি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পরে একদিন আমাদের দুই বোনের মধ্যে ঝগড়া হলো। এই ঝগড়াকে জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কয়েকজন আরও উসকে দেন। তাঁরা আমার বড় বোনকে মারধর করেন। আমাদের আত্মীয় (তাঁর নামও মায়া রানি বণিক) আমাকে কাজের জন্য তাঁর সঙ্গে ভোলায় নিয়ে যান। পরে তাঁর সন্তান হয় না বলে আমার সঙ্গে তাঁর স্বামী মনোরঞ্জন বণিকের বিয়ে দেন। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। আমার দুই ভাইয়েরও আশ্রয় হয় এই বাড়িতে। আর আমার বড় বোন মার খেয়ে অপমানে বিভিন্ন জায়গায় থাকার পর কলকাতায় চলে যান। অভিমানসহ নানা কারণে বোন আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।’

বিউটি জানালেন, বাবার জমিদারি হারানো, মায়ের মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়া, বাবার মৃত্যু, ঝগড়ার জেরে বড়ে বোনের দেশ ছেড়ে যাওয়া—এসব বিষয় তিনি কখনোই মানতে পারেননি। তাই তিনি নিজেও শারীরিক-মানসিকভাবে অসুস্থ হতে থাকেন।

নিজের গল্প শোনানোর সময় বিউটি বারবার বলছিলেন, পুরোনো স্মৃতি মনে পড়লে তিনি স্বাভাবিক থাকতে পারেন না। বাসাতে তিনি যখন একা থাকেন, তখন তাঁর এসব কথা বেশি মনে পড়ে।

বিউটি রানি বণিকের সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে মানিক বণিক
ছবি: প্রথম আলো

বিউটির স্বামী ও তাঁর স্বামীর আগের স্ত্রী ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বিউটি তাঁর দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন দুই ছেলেকে নিয়ে বছিলায় থাকেন।

বিউটি জানান, তাঁর বোনকে দেশে থাকা অবস্থায় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। দেশে বিয়ে করলেও তাঁর সংসারটা টেকেনি। মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে। কলকাতায় যাওয়ার পরও তাঁকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কলকাতায় থাকাকালে নেপালের একজনকে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর স্বামীও মারা গেছেন। তাঁর চার ছেলে। এর মধ্যে এক ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী। স্বামী মারা যাওয়ার আগে বাড়ি করে দিয়ে গেছেন। মায়া এখন তাঁর ছেলেদের সঙ্গেই থাকেন।

বিউটি বললেন, এখন তিনি মাঝেমধ্যে ভাবেন, বোন মায়ার কলকাতায় চলে যাওয়াটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। দেশে থাকলে সামাজিক বাস্তবতায় তিনি আর বিয়ে করতে পারতেন না। ভাইদের সংসারে গলগ্রহ হয়ে থাকতে হতো।

বিউটি দেশে ফেরার পর এখন দুই বোনের মাঝেমধ্যে ভিডিও কলে কথা হয়। মায়ার প্রসঙ্গে বিউটি হাসিমুখে বলেন, ‘আমার বোন আমার থেকেও শারীরিকভাবে সুস্থ আছেন। সব কথা তাঁর মনে আছে। আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছেন। তবে ঝগড়ার কথা তিনি আর মনে রাখেননি। তাঁর বয়স হয়েছে। তাই হয়তো তিনি আর বাংলাদেশে আসতে পারবেন না। তবে আমি আবার সুযোগ পেলে বোনকে দেখতে যাব। আমাদের দুই বোনকে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য আমি আমার বড় ছেলে মানিককে অনেক আশীর্বাদ করি। ওর জন্যই তো জীবদ্দশায় বোনটার দেখা পেলাম।’