দিনে ২২০০ নতুন পরিবার হচ্ছে, সবচেয়ে ছোট পরিবার কোথায় কোথায়

দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য: পরিবারকে ঘিরেই টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়া।

দেশে পরিবারের আকার ছোট হয়ে আসছে। শহর কিংবা গ্রামের বাড়িতে এখন বড় পরিবার কম খুঁজে পাওয়া যায়। আকার ছোট হয়ে এলেও পরিবারের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন বাংলাদেশে ২ হাজার ২০০ নতুন করে পরিবার দেখা দিচ্ছে।

বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, চাচা-চাচি নিয়ে একসঙ্গে যৌথভাবে থাকা-খাওয়ার মতো পরিবার কমে যাচ্ছে। আর্থসামাজিক কারণে এমন পরিবার থাকছে না। অণুপরিবার (নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি) অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী ও তাঁদের সন্তান নিয়ে ছোট পরিবারের সংখ্যাই এখন বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিশু ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ওপর। যদিও পরিবারের এই পরিবর্তন ভালো না মন্দ, তা নিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রে আলোচনা এখনো কম।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ ১৫ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য: পরিবারকে ঘিরেই টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি গড়া। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘে প্রতিবছর ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

জাতিসংঘ বলছে, যেকোনো সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবার হোক না কেন, প্রতিটি পরিবারের নিরাপত্তা ও সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। পরিবারের সদস্যদের অধিকার, সক্ষমতা ও দায়িত্বের ব্যাপারে দৃষ্টি রাখাও সরকারের দায়িত্ব। সরকার থাকবে শক্তিশালী পরিবারের পক্ষে।

পরিবারের সংখ্যা বাড়লেও এর আকার দিন দিন ছোট হতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা কমে আসছে।

অণুপরিবার বাড়ছে

২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশে খানার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩০। পরে ২০২২ সালের জনগণনায় খানার সংখ্যা বেড়ে হয় ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ৫১। অর্থাৎ ১১ বছরে নতুন পরিবার বা খানা হয়েছে ৮৮ লাখ ৩৬ হাজার ৪২১টি। এর অর্থ দেশে প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ নতুন পরিবার হতে দেখা যাচ্ছে।

পরিবারের সংখ্যা বাড়লেও এর আকার দিন দিন ছোট হতে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ পরিবারের গড় সদস্যসংখ্যা কমে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অনুসারে দেশের পরিবারগুলোতে গড় সদস্যসংখ্যা ৪ দশমিক ২। তবে একজন জনসংখ্যাবিদ বলেছেন, বর্তমানে সদস্যসংখ্যা ৪ বা তার চেয়ে সামান্য কম।

পরিবারের আকার যে ছোট হয়ে আসছে, তা দেখা যায় বিবিএসের পরিসংখ্যানে। ২৮ বছর আগে ১৯৯৪ সালে পরিবারে গড়ে সদস্যসংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ৪। ২০০৪ সালের জরিপে দেখা যায়, সদস্যসংখ্যা ৫। ২০২২ সালে দেখা যাচ্ছে, পরিবারের সদস্য কমে ৪ জনে এসেছে।

দ্রুত সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ যৌথ পরিবার ভেঙে অণুপরিবার হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম

কিন্তু দেশের সব জেলার পরিবারের আকার সমান নয়। সুনামগঞ্জ জেলার পরিবারগুলোর গড় সদস্যসংখ্যা ৫.৩। অন্যদিকে সবচেয়ে কম সদস্য ছয়টি জেলায়: বগুড়া, গাজীপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী। এই জেলাগুলোর পরিবারের গড় সদস্য ৩.৭ জন।

সব জেলার পরিবার ছোট হতে দেখা গেলেও ঢাকা ও নওগাঁ—এই দুটি জেলায় পরিবারের আকার বড় হতে দেখা যাচ্ছে। ২০২১ ও ২০২২ সালে ঢাকা জেলার পরিবারপ্রতি সদস্য ছিল ৩.৯ জন। একই সময়ে নওগাঁ জেলার পরিবারপ্রতি সদস্য ছিল ৩.৬ জন। ২০২৩ সালে ঢাকা ও নওগাঁয় পরিবারের সদস্য বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ৪ ও ৩.৭ জন।

সুনামগঞ্জ জেলার পরিবারগুলোর গড় সদস্যসংখ্যা ৫.৩। অন্যদিকে সবচেয়ে কম সদস্য ছয়টি জেলায়: বগুড়া, গাজীপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী। এই জেলাগুলোর পরিবারের গড় সদস্য ৩.৭ জন।

শহর ও গ্রামে পরিবারের আকারে তারতম্য আছে। ১৯৯৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শহরে পরিবারগুলোর আকার ছোট হওয়ার প্রবণতা গ্রামের চেয়ে কিছুটা বেশি।

কেন এই পরিবর্তন

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক আছে। যৌথ পরিবার ভেঙে অণুপরিবার হওয়ার সঙ্গেও সংখ্যা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গেও পরিবার ছোট হওয়ার সম্পর্ক আছে।

জনসংখ্যাবিদদের চোখে পরিবার তিন ধরনের। যৌথ পরিবারে থাকে স্বামী-স্ত্রী, তাঁদের সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি। স্বামী-স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানদের নিয়ে অণুপরিবার। স্বামী-স্ত্রী ও তাঁদের সন্তানের সঙ্গে যদি বাবা-মা বা ভাই বা বোন থাকে, তা হলে তাকে বলা হচ্ছে বর্ধিত পরিবার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রুত সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ যৌথ পরিবার ভেঙে অণুপরিবার হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করে।’

এ দেশে পরিবার ছোট হয়ে আসার কিছু প্রভাব নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা হতে দেখা গেছে। অণুপরিবারে শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। এ ধরনের পরিবারে শিশুদের দেখাশোনা ও প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমে শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র ও প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও শিশুদের দিবাযত্ন কেন্দ্র ও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠছে। তবে দুটি ক্ষেত্রেই ধীরগতি লক্ষ করা যায়। তবে এ বিষয় নিয়ে দেশে বড় পরিসরে গবেষণা হওয়া দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট নীতিমালা ও কর্মকৌশল থাকা দরকার। সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ধরে রাখতে, সমাজকে সচেতন করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মূল লক্ষ্য হবে পরিবার যেন ভালো থাকে।’