তাঁরা খুঁজে দেন সোনা-রুপা

গোপালগঞ্জে মরা মধুমতীর খালে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান বস্তু খুঁজছেন আলিমুল ইসলাম। সম্প্রতি তোলা
ছবি: আকিব মোহাম্মদ

সেদিন কানাইপুরের হুগলাডাঙ্গি গ্রামে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। বাড়ির বউ পুকুরঘাটে কানের দুল হারিয়েছেন। ওজনে ভারী অলংকার হারিয়ে তাঁর মন খারাপ। ওদিকে গৃহকর্তা হিসাব করছেন গয়নার মূল্য। শেষ রক্ষা হয়েছে পুকুরে জমা কাদার ভেতর থেকে গয়না উদ্ধার হওয়ায়।

বর্ষাকালে পুকুরের মাঝখানে প্রায় ২০ ফুট পানির তলা থেকে দুল তুলেছেন তুর খান। কিছুক্ষণের জন্য ফরিদপুরের এক গ্রামের মানুষের চোখে বিশেষ কেউ হয়ে রইলেন এই স্বর্ণ খোঁজা ডুবুরি। এই প্রতিবেদককে তুর বললেন, কানের দুলটা পাওয়ার পর সবাই কী খুশি! গ্রামের মানুষ ভিড় করেছিলেন। কিন্তু পানির নিচে বড়জোর দুই মিনিট নিশ্বাস না নিয়ে থাকা যায়। হৃৎপিণ্ড ফেটে যেতে চায়। এ কাজে শ্রম অনেক।

এ বছরের ২১ জুন দুপুরে তুর খানের ভাগ্যটা ভালোই ছিল। গয়না খুঁজে দেওয়ায় দুই হাজার টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছেন। সব সময় ডুব দিয়ে কাজ হয় না। ‘আছড়া’ দিয়ে টেনে ‘ঝাঁই’র ভেতর কাদা তোলেন।

সেই কাদা ঘেঁটে খুঁজতে হয় হারানো অলংকার। এই আছড়া আর হুসা হচ্ছে স্বর্ণ খোঁজা ডুবুরিদের যুদ্ধাস্ত্র। তুর খান আঞ্চলিক ভাষায় শব্দ দুটি ব্যবহার করলেও অধিকাংশ মানুষ চেনেন আঁকশি আর হুসা নামে। টিন, বাঁশ বা প্লাস্টিক দিয়ে বানানো তিন কোনা হুসার গায়ে থাকে বিজ্ঞাপন ‘আপনার স্বর্ণ ও রুপার গয়না পুকুর বা নদীর ঘাটে হারালে চিন্তা করে কোনো লাভ নাই। একবার খুঁজে দেখুন।’

বহু খুঁজেও যে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পাওয়া যায় না, তা ভালো জানেন গোপালগঞ্জের আলিমুল ইসলাম। এখন বয়স প্রায় ৫০। কত জায়গার কত নদী ও পুকুরে তিনি নেমেছেন হিসাব নেই। একসময় সপ্তাহে ৬ থেকে ১০টি কাজ পেতেন। তিনি বলেন, গ্রামে গ্রামে হেঁটে বাঁশের চোঙা ব্যবহার করে ডাকতেন—‘হারিয়েছে কারও কিছু? এই যে এখানে স্বর্ণ খুঁজা ডুবুরি।’ কোথাও কোথাও তাঁরা ডুগডুগি বাজাতেন। সেই শব্দে মানুষ বুঝত, গ্রামে এসেছে ডুবুরি।

গত ১৫ জুন কথা হলো আলিমুল ইসলামের সঙ্গে। মাস দুয়েক আগে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দীঘলিয়ার এক পুকুরে নেমেছিলেন। তিন ঘণ্টা খুঁজেও সেদিন উদ্ধার করতে পারেননি হারানো গয়না। হাতে ২০টি টাকা ধরিয়ে সাক্ষাৎ বিদায় দিয়েছেন গৃহকর্তা। প্রথম আলোকে আলিমুল বলেন, ‘এখন নারীরা আগের মতো নদী বা পুকুরে গোসল করেন না। সচেতন বলে ব্যবহার করেন ইমিটেশনের গয়না। তা ছাড়া সেই নদী ও পুকুর কোথায়? সব শুকিয়ে যাচ্ছে। চাইলেও এই পেশায় থাকতে পারব না। বয়স হলে দমও কমে যায় ডুবুরির।’

স্বর্ণ খোঁজা ডুবুরি অধিকাংশই যাযাবর। বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁরা একের ভেতর তিন। পানিতে ডুব দিয়ে গয়না খুঁজে আনেন, জরি–বুটি মাদুলি বিক্রি করেন অথবা চুড়ি–ফিতা–আলতা বিক্রি করেন।

তাঁদের স্ত্রীরা শিঙা ফুঁকে বিষ–ব্যথা নামান গ্রামে ঘুরে ঘুরে। বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠী বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, পানি থেকে গয়না খুঁজে আনা সম্প্রদায়টি হচ্ছে শান্দার বেদের মধ্যে কুড়িন্দা উপ–উপগোত্রের। এই কাজ করে তাঁদের মাসিক আয় আনুমানিক সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা। তবে তাঁরা যদি আংটি ও মাদুলি বিক্রি করেন, তাহলে আয় আট–নয় হাজার টাকা পর্যন্ত হয়।

বেদে গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন ‘বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি অংশ যাঁরা নানা রকম জিনিস বিক্রি করেন; স্বর্ণ খোঁজা ডুবুরি এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে সাপের খেলা দেখানো বেদেরা নিজেদের আরেকটু কুলীন মনে করেন। তবে স্বর্ণ খোঁজা ডুবুরিরা বহুদিন ধরে পেশা বদলাচ্ছেন।’

নদীমাতৃক দেশে একসময় বৈচিত্র্যময় অনেক পেশার ভেতর এই পেশাও ছিল। এখন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জায়গা ছাড়া আর খুঁজেও পাওয়া যায় না তাঁদের। কোনো কোনো গ্রামে এখনো বিদ্যুতের খুঁটির গায়ে লেখা দেখা যায় স্বর্ণ খোঁজা ডুবুরির ফোন নম্বর। নদী, নালা, জলাশয়, পুকুরনির্ভর জীবিকা তাঁদের। বেদে সম্প্রদায়ের এই অংশ ঘুরে ঘুরে সে জায়গার কাছাকাছি গিয়ে কিছুদিনের জন্য থিতু হয়।

এমন একটি নম্বর লেখা আছে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের রাস্তার পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে। সেই নম্বরে ফোন করে পরিচয় হলো সদরপুরের আগুন নামের এক ডুবুরির সঙ্গে। তরুণ বয়সেই বিকল্প উপার্জন হিসেবে বেছে নিয়েছেন মুরগির খামারের চাকরি। পানির তলা থেকে গয়না খুঁজে আনার কাজটি যে আসলে কবে বিকল্প হয়ে গেছে, নিজেও জানেন না তিনি।