স্থাপনা নির্মাণে রড কেনার সময়
এখন শহর বা গ্রামে নানা ধরনের ভবন তৈরি হচ্ছে। কংক্রিট ভবন নির্মাণের মূল উপাদান হলো পানি, পাথর বা পাথরকুঁচি, বালু, সিমেন্ট ও এমএস রড। রডের যথাযথ গুণ নিশ্চিত করে ভূমিকম্পসহনীয় ভবন নির্মাণ করা যায়। ভবন নির্মাণে ব্যবহার্য এমএস রডের সঠিক গুণ সম্পর্কে নূ৵নতম ধারণা থাকা প্রয়োজন। রডের একক ওজন, ইল্ড স্ট্রেন্থ, আলটিমেট স্ট্রেন্থ, প্রসারণ, বেন্ড টেস্ট ও ডিফর্মেশন ইত্যাদি গুণ পরীক্ষা করে রডের সক্ষমতা যাচাই করা প্রয়োজন।
রডের কারিগরি বিষয়
একটি নির্দিষ্ট ব্যাসের রডের একক দৈর্ঘ্যে (যেমন ১ মিটার) নির্দিষ্ট নূ৵নতম ওজন থাকা প্রয়োজন, যা একক ওজন পরীক্ষা করে জানা যাবে। সাধারণভাবে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টান বা পীড়ন প্রয়োগ পর্যন্ত রডের আনুপাতিক প্রসারণ ঘটে, সেই পরিমাণ টান বা পীড়ন হলো ইল্ড স্ট্রেন্থ। রডের গ্রেড বলতে কারিগরি ভাষায় ইল্ড স্ট্রেন্থকে বোঝায়। সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টান রড ছিঁড়ে যাওয়ার আগে সহ্য করতে পারে, সেটি আলটিমেট স্ট্রেন্থ। পরীক্ষা করে রড টেনে ছিঁড়ে ফেলার পর এর মূল দৈর্ঘ্যের তুলনায় কতটুকু লম্বা হলো, তাকে প্রসারণ বলা হয়।
রডকে সহজে বাঁকা করা যায় কি না, যথাযথ নমনীয় কি না, সেটির পরীক্ষা বেন্ড টেস্ট। রডের পৃষ্ঠতলে যে উঁচু–নিচু খাঁজ থাকে, তার মাপ যথাযথ আছে কি না, তা ডিফরমেশন মেজারমেন্ট করে জানা যায়। ভূমিকম্পসহনীয় ডিজাইনের জন্য ইল্ড ও আলটিমেট স্ট্রেন্থ ও প্রসারণ গুরুত্বপূর্ণ। টেস্ট করে পাওয়া ইল্ড স্ট্রেন্থের মান রডের গ্রেডের মান থেকে বেশি হতে হবে। গ্রেডের মানের তুলনায় ১২৫ মেগাপ্যাসকেলের বেশি হতে পারবে না। যেমন ৪২০ গ্রেডের রড পরীক্ষা করলে ইল্ড স্ট্রেন্থ সব সময় ৪২০ মেগাপ্যাসকেলের বেশি হবে, ৫৪৫ মেগাপ্যাসকেল থেকে কম হবে। পরীক্ষা করে পাওয়া আলটিমেট ও ইল্ড স্ট্রেন্থ মানের অনুপাত অবশ্যই ১ দশমিক ২৫ বা তার বেশি হতে হবে। এ ছাড়া পরীক্ষা করে ছিঁড়ে ফেলার পর রডের প্রসারণ কমপক্ষে ১২–১৪ শতাংশ বা তার বেশি হতে হবে (২০০ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে)। স্টিলে গুণ যাচাইয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ফ্যাটিগ গুণ। সাধারণভাবে বলা যায়, একটি ভালো মানের স্টিলে উপযুক্ত ফ্যাটিগ বৈশিষ্ট্য ও থাকা প্রয়োজন। সেতু ডিজাইনে ফ্যাটিগ একটি খুব প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। কংক্রিট ভবন নির্মাণে ফ্যাটিগ বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত দু-একটি ভালো প্রতিষ্ঠানের তৈরি এমএস রডে ওপরের সব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
ভূমিকম্প প্রতিরোধে রডের ব্যবহার
ভূমিকম্পসহনীয় স্থাপনা নির্মাণে প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় নিয়মাবলি বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০-এ বিস্তারিত বলা আছে। কংক্রিট ভবনের বিম, কলাম, শিয়ার ওয়াল ইত্যাদি অংশ ভূমিকম্পের সময় ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ভবনের এসব অংশে জাতীয় নিয়ম মেনে প্রধান রড হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০০-৪২০ গ্রেডের রড ব্যবহার করা যাবে। এর থেকে উচ্চতর গ্রেডের রড এসব অংশে ব্যবহার করা যাবে না। কাঠামোর যে অংশ ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে না; যেমন স্ল্যাব। সেখানে ৫০০ গ্রেড পর্যন্ত রড ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ৫০০ গ্রেড বা প্রয়োগ বিবেচনায় উপযুক্ত ক্ষেত্রে ৬০০ গ্রেড পর্যন্ত রড ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোন রড কোন কাজের
ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত রডের অন্যতম প্রকারভেদ হলো টিএমটি রড ও এমএস রড। এগুলোর উৎপাদনপ্রক্রিয়া ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। টিএমটি রডের পূর্ণরূপ হলো থার্মো মেকানিক্যালি ট্রিটেড বার। টিএমটি প্রক্রিয়ায় কম গ্রেডের কাঁচামাল ব্যবহার করে উচ্চ গ্রেডের রড তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় রড উত্তপ্ত করার পর দ্রুত ঠান্ডা করা হয়। তারপর আবার স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরিয়ে আনা হয়। এতে রডের বাইরের অংশে শক্ত একটি স্তর (মার্টেনসাইট) এবং ভেতরের অংশে নমনীয় কোর (ফেরিট-পার্লাইট) তৈরি হয়ে টিএমটি রড উচ্চ প্রসারণ শক্তি ও ভালো নমনীয়তা দেয়।
অন্যদিকে এমএস রডের পূর্ণরূপ মাইল্ড স্টিল রড। এটি সাধারণত অপেক্ষাকৃত কম কার্বনযুক্ত ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয় এবং টিএমটি রডের মতো বিশেষ প্রক্রিয়াকরণ করা হয় না। এমএস বা টিএমটি রড যে প্রক্রিয়ায় তৈরি হোক না কেন, সেটি ওপরে আলোচিত গুণসম্পন্ন হলেই তখন তা ভূমিকম্প সহনীয় কংক্রিট স্থাপনায় ব্যবহার করা যাবে।
ভূমিকম্পে টেকসই ভবনের জন্য কার্যকর রডের খোঁজ
নির্মাণকাজে ব্যবহৃত রডের গুণগত মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রড পাওয়া যায়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অনেক প্রতিষ্ঠানই ভূমিকম্পসহনীয় নির্মাণের জন্য নানা রকম চটকদার বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, এসব বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবেন না। সব সময় অনুমোদিত ও স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের রড কেনার চেষ্টা করুন। ভালো ব্র্যান্ডের রড সাধারণত নির্ধারিত মানদণ্ড মেনে তৈরি হয়, যা ভবনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। রড কেনার সময় ব্র্যান্ডের নাম, লোগো ও উৎপাদনের তারিখ ইত্যাদি দেখে নিন। রড কয়েক মাস ফেলে রাখলে যে হালকা মরিচা পড়ে, তা ক্ষতিকর নয়। রডে বেশি মরিচা বা ফাটল আছে কি না, তা যাচাই করুন। প্রয়োজনে মরিচা যথাযথভাবে পরিষ্কার করে ব্যবহার করুন। তবে বেশি মরিচার কারণে যদি রডের ব্যাস নির্দিষ্ট মাত্রা থেকে কমিয়ে দেয়, তাহলে সেই রড ব্যবহার করা যাবে না। রডের ওজন ও মূল্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একই ব্যাসের রডের ওজন নির্দিষ্ট থাকে। কেনার সময় প্রতি বান্ডিলের ওজন মেপে নিন ও তা নির্দিষ্ট ওজনের সঙ্গে মিলে যায় কি না, যাচাই করে নিন। শুধু কম দাম দেখে রড কিনবেন না। আপনার স্থাপনা নির্মাণের আগে অভিজ্ঞ প্রকৌশলী বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
ড. খান মাহমুদ আমানত: অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়