বায়ুদূষণকে জরুরি বিষয় হিসেবে দেখতে হবে

বায়ুদূষণ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দেশে বায়ুদূষণ ভয়াবহ জায়গায় চলে গেছে। সামগ্রিকভাবে দেশের বেশির ভাগ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি সবকিছু বায়ুদূষণের কারণে পিছিয়ে পড়ছে। এই দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও মাঠে তার বাস্তবায়ন কম। আর বায়ুদূষণ বিধিমালায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৩টি মন্ত্রণালয় ও ৩৫টি সংস্থা আছে। তারা যথাসময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন না করায় চাপটা একতরফাভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের দিকে চলে আসে। তাই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব সংস্থাকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিতে হবে।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স মিলনায়তনে এক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। গবেষণা সংস্থা বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে ‘নির্মল বায়ু নিশ্চিতকরণ: প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ওই সংলাপে রাজনীতিবিদ, গবেষক ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘জলবায়ু সম্মেলনে আমরা বারবার বলছি, আমরা ভিকটিম। কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের নিয়ম না মানি, তাহলে তো আমাদের বক্তব্য দ্বিমুখী হয়ে যায়। বায়ুদূষণের বিষয়টি শুধু বিদেশের কাছে তুলে ধরার বিষয় না, দূষণ নিয়ন্ত্রণ জনস্বাস্থ্যের বিষয়। আমাদেরকে এখন নির্ধারণ করা দরকার আমার নগরে কতটুকু সবুজ রাখতে হবে, কতটুকু জলাভূমি রাখব। এখান থেকে আমাদের কোনোভাবেই সরে আসা যাবে না।’

সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা অঘোষিত জরুরি অবস্থায় আছি। বায়ুদূষণে আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ শহরও বিশ্বমানের চেয়ে ৯ গুণ বেশি দূষিত। আমাদের এখন গবেষণা দরকার অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি কত বাড়ছে? এটার ক্ষতি উন্নয়নের চেয়েও বেশি কি না? আমরা সার্বক্ষণিক একটা দূষিত পরিবেশে আছি। বর্তমান সময়ে নিজ বাসায়ও আমরা নিরাপদ না। এমন পরিস্থিতিতে কথার চেয়ে কাজ বেশি প্রয়োজন। আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হবে।’

জাতীয় সংলাপে মূল বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বায়ুমান উন্নয়ন না করলে ভবিষ্যতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। বায়ুমান উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস ও বায়ুর দূষক নিঃসরণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা। যার ফলশ্রুতিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবও তুলনামূলকভাবে কমে আসবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান আদেল বলেন, ‘বাতাস ছাড়া আমরা এক সেকেন্ডও বাঁচব না। আগে আমরা জলবায়ুকে আগামীর হিসেবে আলোচনা করতাম। এখন তা বর্তমানের সমস্যা হয়ে গেছে। আমরা যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারিনি। এটা আমাদের একটা বড় ত্রুটি। গণপরিবহনব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পারিনি। এটাও একটা কারণ।’

অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আমরা এখন আপস করছি বটে, তবে একেবারে ছেড়ে দিলে চলবে না। আমরা কখন কতটুকু উন্নয়নের সঙ্গে কোন মানে পৌঁছাব, সেটা নির্ধারণ করতে হবে। অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এখানে আলোচনায় এসেছে সংসদে এক দিন অন্তত পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আমরা সংসদে এক দিন না পারি, এক ঘণ্টা হলেও করব।’

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বিদ্যুতে সবাই উপকারভোগী অথচ বায়ুদূষণের কথা এলেই কেন যেন সবাই বিদ্যুৎকে সবার আগে দোষারোপ করছি। আমরা এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কয়লাভিত্তিক অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে কাজ করছি। বায়ুদূষণ রোধে প্রকৃতপক্ষে আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তির বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’

সুইডেন দূতাবাসের স্বাস্থ্য বিভাগের ফার্স্ট সেক্রেটারি ড্যানিয়েল নোভাক বলেন, মানুষের তিনটি প্রধান রোগের কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে শিশু, নারী, গর্ভবতী এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য রোগীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ুদূষণ একটি স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থায় পৌঁছেছে। তাই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকায় সবুজ ও জলাভূমি কমে যাওয়ার কারণে এই শহরে বায়ুদূষণ বাড়ছে। পূর্বাচলসহ যেখানে নতুন শহর গড়ে উঠছে, সেখানে সবুজ রক্ষায় কঠোর হতে হবে। ঢাকায় বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস উন্নয়নকাজের দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করা।

এখানে কঠোর হওয়া দরকার এবং বায়ুমানের তাৎক্ষণিক তথ্য নগরবাসীকে জানানো দরকার। কারণ, কোথাকার বায়ু কতটুকু ক্ষতিকর, সেটা জানার এবং সেখানে কেউ যাবে কি যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার জনগণের আছে।
 
সভায় অন্যান্যের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী নকী, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও ওয়াশ প্রজেক্টের টেকনিক্যাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার সন্তোষ কুমার দত্ত, নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এস এম মনজুরুল হান্নান খান, পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বক্তব্য দেন।