দুপুরে তাঁরা ঘুমাচ্ছিলেন, হঠাৎ ট্রেনের বগি এসে ঘরের ওপর পড়ে

লাইনের পাশে হেলে পড়েছে বিজয় এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি। এতে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনায় আহত হন বেশ কয়েকজন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার তেজের বাজার এলাকায় আজ রোববার দুপুরেছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লায় আজ রোববার ট্রেন দুর্ঘটনার পরপর স্টেশনমাস্টার বলেছিলেন, গরমে রেললাইন বেঁকে গিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এ বক্তব্যের সত্যতা পাননি রেলের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা। তাঁদের ধারণা, ২০৮ নম্বর রেলওয়ে সেতুর নড়বড়ে কাঠের স্লিপার ও ত্রুটিপূর্ণ নাট-বল্টু দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হাসানপুর রেলস্টেশনের অদূরে তেজের বাজার রেলক্রসিং এলাকায় এই দুর্ঘটনায় বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের ৯টি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এ সময় অন্তত আধা কিলোমিটার রেললাইন দুমড়েমুচড়ে যায়। লাইনচ্যুত বগিগুলো পাশের মাঠে ও বাড়িতে গিয়ে পড়ে। এতে যাত্রীসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে জামালপুরে যাচ্ছিল। বেলা পৌনে দুইটার দিকে তেজের বাজার রেলক্রসিংয়ের দক্ষিণে শিহর চিওড়া ও উরুকুটি এলাকার মাঝামাঝি স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

দুর্ঘটনার পর হাসানপুর রেলস্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার মং গু মারমা বলেছিলেন, গরমের কারণে রেললাইন বাঁকা হয়ে গেছে। এ কারণে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এর সত্যতা পাননি রেলের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা। এখন ধারণা করা হচ্ছে, ২০৮ নম্বর রেলওয়ে সেতুর নড়বড়ে কাঠের স্লিপার ও নাট-বল্টুতে ত্রুটি থাকায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার পর ট্রেনের ইঞ্জিনের হুক খুলে গেলে ইঞ্জিনসহ চালক রক্ষা পান। পরে চালক ইঞ্জিনটিকে হাসানপুর রেলস্টেশনে নিয়ে যান।

দুর্ঘটনা তদন্তে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনিসুর রহমানকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবেন।

আজই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা। তিনি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ঘটনাস্থল থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রেললাইন বেঁকে যাওয়ার কারণে বগি লাইনচ্যুত হওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, সরেজমিনে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ঠিক কী কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। একই কথা জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির এক সদস্যও।

দুর্ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সাড়ে চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ট্রেন চলাচল আবার শুরু হয়।

আরও পড়ুন

এর আগে গত বছরের ১৬ এপ্রিল কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হাসানপুর স্টেশনেও পণ্যবাহী ট্রেনের সঙ্গে সোনার বাংলা ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে সোনার বাংলা ট্রেনের সাতটি বগি ও ইঞ্জিন এবং পণ্যবাহী ট্রেনের দুটি কনটেইনার ও গার্ডরুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হয়েছিলেন অন্তত ৫০ যাত্রী।

কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ শামসুল তাবরীজ, নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন ও কুমিল্লার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া কুমিল্লা, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম থেকে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি দল ঘটনাস্থলে যায়। সন্ধ্যায় বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (চট্টগ্রাম) সাইফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।

লাইনচ্যুত বগি, আহত ১৫

বগি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া গেছে ১১ জনের। তাঁরা হলেন ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট মো. কাজল (২২), সাজেদুল (২৮), যাত্রী মো. মিরাজ (৪৫), আফজল হোসেন (২৯), মো. রনি (২৮), লাকসামের নরপাটি এলাকার বাসিন্দা মো. রিয়াজ (২৫), নাঙ্গলকোট পৌরসভার হাজি বাড়ির তাবারুক ইসলাম ফারুক (২৪), কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার শামছুন্নাহার (৩৩)। ট্রেনের একটি বগি শিহর চিওড়া গ্রামের মো. স্বপন মিয়ার ঘরের ওপর পড়ে। এতে তিনি স্ত্রী, শিশুকন্যাসহ আহত হন। আহতদের নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট আবদুস সাত্তার ও আবুল বাশারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ট্রেনটি চট্টগ্রাম থেকে বেলা ১১টা ২০ মিনিটে জামালপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। পৌনে দুইটার দিকে হাসানপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন শিহর চিওড়া ও উরুকুটি নামক স্থানে আসার পর ট্রেনটি হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী মাঠে গিয়ে পড়ে। ট্রেনের জানালা খোলা থাকায় যাত্রীরা জানালা দিয়ে বের হয়ে যান।

ট্রেনের যাত্রী শামছুন্নাহার বলেন, ‘আমি বোন, দুই বাচ্চাসহ ট্রেনের ‘ঢ’ বগিতে ছিলাম। দুর্ঘটনার সময় ট্রেনের ভেতরে ঝনঝন শব্দ হয় এবং ধুলা উড়তে থাকে। পরে বগিটি লাইনচ্যুত হওয়ার পর আমরা বাচ্চাদের নিয়ে বগি থেকে বের হই।’

শিহর চিওড়া গ্রামের স্বপনের স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, দুপুরে তাঁরা ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ ট্রেনের একটা বগি তাঁদের ঘরের ওপর এসে পড়লে তাঁরা তিনজন আহত হন।

নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসমাইল হোসেন বলেন, ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনায় চার-পাঁচজন যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন।

ট্রেন চলাচল শুরু

কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ট্রেন দুর্ঘটনার পর বেলা তিনটা থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সাড়ে চার ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এই সময় কক্সবাজার থেকে আসা ঢাকাগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যায়। তিনটি ট্রেন নির্ধারিত দুই থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ছাড়লেও মহানগর গোধূলীর যাত্রা বাতিল করা হয়।