বায়ুদূষণেও সবল আমগাছ

দূষণ কমাতে গাছের ভূমিকা অনেক বড়। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে আমগাছকে প্রাধান্য দেওয়ার সুপারিশ।

মাঘ মাসেই মুকুলে ছেয়ে গেছে আমগাছ। প্রকৃতিতে ছড়াচ্ছে আমের মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। স্টেশন সড়ক, বগুড়া শহর, ৩ ফেব্রুয়ারিছবি: সোয়েল রানা

আম পরিচিত ফল। দেশের সব এলাকায়, এমনকি বড় বড় শহরেও কমবেশি আমগাছ রয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, দূষিত বায়ুর মধ্যেও আমগাছের টিকে থাকার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে আমগাছকে প্রাধান্য দেওয়ার সুপারিশ করেছেন তাঁরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা মেহগনি, পেয়ারা, কাঁঠাল ও আমগাছের দূষণ–সহিষ্ণুতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা দেখেছেন, সবচেয়ে কম দূষণ সহ্য করতে পারে মেহগনি। সবচেয়ে বেশি দূষণ সহ্য করতে পারে আমগাছ। কাঁঠালগাছের দূষণ সহ্য করার ক্ষমতা পেয়ারাগাছের চেয়ে বেশি।

ছয় সদস্যের গবেষণা দলের প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মুহাম্মদ নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চারটি গাছ নিয়ে গবেষণা করেছি। দেখতে পেয়েছি আমগাছের মধ্যেই বৈরী পরিবেশে বেঁচে থাকার বৈশিষ্ট্য বেশি। তবে দেশের সব প্রজাতির গাছের মধ্যে বায়ুদূষণে টিকে থাকার দিক থেকে আমগাছই সেরা, এটা আমরা বলছি না। আমরা অন্যান্য গাছ নিয়েও গবেষণা অব্যাহত রেখেছি।’

বায়ুদূষণ এখন আর বৈশ্বিক সমস্যা নয়, এটি বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ সমস্যা। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকার দূষণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনা বেড়েছে। একই সঙ্গে নগর এলাকায় গাছের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশও আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের এই গবেষণাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন নগরবিদেরা।

গবেষণার ফলাফলকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নগরকে সবুজ ও দূষণমুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা সিটি করপোরেশনের করা উচিত। তারা করেনি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এই গবেষণার ফলাফল তারা মহানগরের দূষণ প্রতিরোধে কাজে লাগাতে পারে। অন্যদিকে এই তথ্য পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের একটি হাতিয়ার হতে পারে।’

বাংলাদেশে নগরায়ণের যে ধারা চলছে, তাতে বায়ুদূষণ অব্যাহতই থাকবে। এই পরিস্থিতিতে দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূটিতে দূষণ প্রতিরোধী সঠিক প্রজাতির গাছ নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে
মুহাম্মদ নূরুল হুদা, জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র

কোন পদ্ধতিতে গবেষণা

সাতটি এলাকাকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একটি ছাড়া বাকি ছয়টি এলাকা নিয়মিতভাবে কলকারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের দূষণের শিকার। তবে সব এলাকার দূষণ সমান নয়। নারায়ণগঞ্জের মদনপুর ও রাজধানীর কদমতলী এলাকায় বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা রয়েছে। রাজধানীর ফার্মগেট ও গাবতলী এলাকায় যান চলাচল বেশি দেখা যায়। পল্লবী এলাকা আবাসিক। দোয়েল চত্বর একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রাক্‌–আবাসিক এলাকা এবং চুয়াডাঙ্গার গ্রাম হাসাদহ। গ্রামটিতে কলকারখানা বা যানবাহনের দূষণ নেই। এই সাতটি এলাকাতেই মেহগনি, পেয়ারা, কাঁঠাল ও আমগাছ আছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিটি প্রজাতির তিনটি গাছের পাতা সংগ্রহ করেন গবেষকেরা। নমুনা হিসেবে নেওয়া হয় সবচেয়ে নিচের ডালের সবচেয়ে নতুন পাতা। একই সময়ে প্রতিটি এলাকার বায়ুতে থাকা পিএম১০ পরিমাপ করা হয়। পিএম১০ সূক্ষ্মতম পদার্থকণা, যার উপস্থিতি বায়ুদূষণের কারণ।

গাছের দূষণ–সহিষ্ণুতা পরিমাপের মাপকাঠি চারটি। পাতায় পিএইচের (ক্ষার ও অম্লের মাপকাঠি) পরিমাণ, পানি ধারণ করার ক্ষমতা, পাতায় ক্লোরোফিলের পরিমাণ এবং অসকোরবিক অ্যাসিডের (ভিটামিন সি জাতীয় অম্ল) পরিমাণ। পিএইচ কমবেশি না থাকা এবং পানি, ক্লোরোফিল ও অসকোরবিক অ্যাসিড বেশি থাকার অর্থ সেই গাছের দূষণ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি।

কী জানা গেল

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১৫০ থেকে ২৩০টি পিএম১০ থাকলে তা সহনীয়। গবেষকেরা বলছেন, কেবল হাসাদহের বাতাসে পিএম১০ ছিল সহনীয় মাত্রায়। বাকি ছয়টি এলাকার বাতাসে দূষণ সৃষ্টিকারী পদার্থকণা ছিল সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
সংগৃহীত পাতাগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে ধোয়ার পর সেগুলোর প্রাণরাসায়নিক এবং পদার্থরাসায়নিক বিশ্লেষণ করেন গবেষকেরা।

পদার্থরাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমের পাতায় থাকা পানির পরিমাণ অন্য তিনটি প্রজাতির প্রতিটির পাতায় থাকা পানির চেয়ে বেশি। যে গাছের পাতায় পানি বেশি থাকে, তার দূষণ প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। অন্যদিকে পাতায় পিএইচের পরিমাণ চার প্রজাতির গাছের পাতায় প্রায় সমান পরিমাণে ছিল।

প্রাণরাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চার প্রজাতির গাছের মধ্যে আমগাছের পাতায় অসকোরবিক অ্যাসিডের পরিমাণ অনেক বেশি। যে গাছের পাতায় অসকোরবিক অ্যাসিড বেশি, সেই গাছের সালফার ডাই–অক্সাইডের দূষণ সহ্য করার ক্ষমতাও বেশি। অন্যদিকে কাঁঠালগাছের পাতায় ক্লোরোফিলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে আমের পাতার অবস্থান কাঁঠালের পাতার পরেই।

এই বিশ্লেষণের পর গবেষকেরা বলছেন, বায়ুদূষণ–সহিষ্ণুতা সূচকে আমগাছের অবস্থান অন্য তিনটি প্রজাতির গাছের চেয়ে ওপরে। আমের পরেই আছে কাঁঠালগাছ, এরপর পেয়ারাগাছ। চারটি গাছের মধ্যে বায়ুদূষণ–সহিষ্ণুতা সূচকে সবচেয়ে পেছনে মেহগনিগাছ।

গবেষকদের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটি ২০২০ সালে রোটলেজ প্রকাশনা সংস্থার এনভায়রনমেন্টাল ক্লেইমস জার্নালে ছাপা হয়। প্রবন্ধের উপসংহারে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, যে গাছগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে, সেগুলো ঢাকা শহরে জৈব–সূচক হিসেবে কাজ করছে। গাছের বায়ুদূষণ–সহিষ্ণুতা নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার, তা হলে শহরে বা রাস্তার পাশে কোন প্রজাতির গাছ লাগানো উচিত, তার বৈজ্ঞানিক যুক্তি পাওয়া যাবে।

আরও কী গবেষণা হচ্ছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকদের সঙ্গে গতকাল এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, আরও নতুন কয়েকটি প্রজাতির গাছ অন্তর্ভুক্ত করে তাঁদের গবেষণাকাজ চলছে। কোন গাছের পাতায় বেশি ধুলা জমে, কেন জমে, তা জানার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা জানতে পেরেছেন, দূষণের কারণে গাছের পাতার পত্ররন্ধ্র ছোট হয়ে আসে। কেন এমন হয়, কোন গাছের পাতায় এই প্রবণতা বেশি, তার বিশ্লেষণ তাঁরা করছেন।

কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী মুহাম্মদ নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে নগরায়ণের যে ধারা চলছে, তাতে বায়ুদূষণ অব্যাহতই থাকবে। এই পরিস্থিতিতে দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূটিতে দূষণ প্রতিরোধী সঠিক প্রজাতির গাছ নির্বাচন জরুরি হয়ে পড়েছে।’