চট্টগ্রামে পূবালী ব্যাংকের গাড়ি থেকে সাত বছর আগে ‘হাওয়া’ হয়ে যাওয়া সাড়ে ৫০ লাখ টাকার এখনো হদিস পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় করা মামলার বিচারও শেষ হয়নি। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তাসহ পাঁচজন। ইতিমধ্যে তাঁরা সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছেন। থানা-পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করলেও টাকা হারানোর রহস্যের কূলকিনারা পাওয়া যায়নি।
জামিনে থাকা পাঁচজন হলেন পূবালী ব্যাংক চট্টগ্রাম সিডিএ করপোরেট শাখার জুনিয়র অফিসার-ক্যাশ (সাময়িক বরখাস্ত) রাজিবুর রহমান, আর্মড গার্ড সদস্য (সাময়িক বরখাস্ত) আশিকুর রহমান, আনজুর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং গাড়িচালক বিজয় কুমার দাশ।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পূবালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে টাকা সংগ্রহ ও পৌঁছে দিতে মাইক্রোবাস নিয়ে বের হন ব্যাংকটির কর্মকর্তা রাজিবুর রহমানসহ বাকি চার আসামি। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ব্যাংকটির চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদের শেখ মুজিব রোড শাখা থেকে সাড়ে ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে সীতাকুণ্ড শাখার উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। সেখান থেকে ৮১ লাখ টাকা সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে রওনা দেন।
সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পরপরই রাজিবুর রহমান বুঝতে পারেন, গাড়িতে থাকা টাকার একটি বস্তা নেই। তখন তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে সীতাকুণ্ড শাখায় ফিরে আসেন। এর পর পূবালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে টাকার একটি বস্তা হারিয়ে যাওয়ার কথা জানান।
এ ঘটনায় পূবালী ব্যাংকের চট্টগ্রাম সিডিএ করপোরেট শাখার তৎকালীন সহকারী মহাব্যবস্থাপক তৌফিকুর রহমান বাদী হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেন। মামলায় ওই দিন টাকা বহনে নিয়োজিত ব্যাংক কর্মকর্তা রাজিবুর রহমানসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। সীতাকুণ্ড থানার পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করে। এর ১১ মাস পর মামলাটির তদন্ত শুরু করে দুদক।
তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের নভেম্বরে দুদক চট্টগ্রামের তৎকালীন সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবির রাজিবুর রহমানসহ ওই পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৪০৯, ১০৯, ১২০(খ) ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের (৫) ২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পাঁচজন আসামি পরস্পর যোগসাজশে পূবালী ব্যাংকের সাড়ে ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তবে কীভাবে টাকাগুলো গাড়ি থেকে সরানো হয়েছে, তা অভিযোগপত্রে জানানো হয়নি। আরও বলা হয়েছে, ঘটনার দিন টাকা বহনকারী গাড়িতে মোট পাঁচজনের দল থাকবে বলে একটি চিঠি ইস্যু করা হয়েছিল। চিঠিতে আর্মড গার্ড মো. সাহাবুদ্দিনের নাম ছিল। কিন্তু তাঁর নাম বাদ দেন ব্যাংক কর্মকর্তা রাজিবুর। যুক্ত করেন আনজুর রহমানকে। অথচ সেদিন সাহাবুদ্দিন ব্যাংকে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
দুদকের তদন্তে আরও বলা হয়েছে, পূবালী ব্যাংক সীতাকুণ্ড শাখা থেকে টাকা সংগ্রহের সময় ব্যাংকের সামনে থাকা মাইক্রোবাসে ছিলেন আনজুর রহমান। বাকি চারজন ব্যাংকে প্রবেশ করেন। ২০ মিনিট পর তাঁরা বেরিয়ে আসেন। কিছু দূর যাওয়ার পর রাজিবুর জানান, টাকাভর্তি একটি বস্তা গাড়িতে নেই। এই ২০ মিনিটের মধ্যেই গাড়িতে থাকা টাকার বস্তাটি সরিয়ে নেওয়া হয়।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন হুমায়ুন কবির। তিনি বর্তমানে দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত। গতকাল শুক্রবার হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, গাড়ি থেকে সাড়ে ৫০ লাখ টাকাভর্তি বস্তা কীভাবে সরানো হলো, সে বিষয়ে পাঁচ আসামির কেউই জিজ্ঞাসাবাদে কিছু স্বীকার করেননি। ঘটনাস্থলের পাশের একটি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। বিদ্যুৎ না থাকায় আরেকটি সিসি ক্যামেরা ওই সময় সচল ছিল না। তাই হারানো টাকার সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুনসী আবদুল মজিদের আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলার বাদী সাক্ষ্য দেন। ১৮ সাক্ষীর মধ্যে আরও ১৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি রয়েছে।
মামলাটি কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান দুদকের আইনজীবী কাজী ছানোয়ার আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। তবে হারানো টাকা এখনো উদ্ধার না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।
মামলার বাদী ও পূবালী ব্যাংক চট্টগ্রাম সিডিএ করপোরেট শাখার তৎকালীন সহকারী মহাব্যবস্থাপক তৌফিকুর রহমান বর্তমানে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। মামলাটির অগ্রগতি ও টাকা উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মামলা চলছে। তাই কিছু বলতে চাই না। এ ব্যাপারে পুলিশ ও দুদক ভালো বলতে পারবে।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে রাজধানীর উত্তরায় গাড়ি থামিয়ে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ডাকাতি হয়েছে। জানা গেছে, ডাকাত দলটি মাইক্রোবাসে এসে সিকিউরিটি কোম্পানি মানি প্ল্যান্ট লিংক (প্রাইভেট) লিমিটেডের গাড়ির গতি রোধ করে। এ সময় তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না। এরপর তাদের একজন নিজেকে ডিবি পরিচয় দেন এবং গাড়িতে থাকা কর্মীদের চড়থাপ্পড়-ঘুষি মেরে টাকাভর্তি চারটি ট্রাংক ছিনিয়ে নেন। ওই টাকা মিরপুর ডিওএইচএস থেকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সাভারের ইপিজেড বুথে নেওয়া হচ্ছিল।
এ ঘটনার পরপরই ডাকাতদের গ্রেপ্তার ও টাকা উদ্ধারে অভিযানে নামে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গ্রেপ্তার করা হয় সাতজনকে। তাঁদের মধ্যে ছয়জন সিকিউরিটি কোম্পানির কর্মী ও একজন ডাকাতিতে ব্যবহৃত গাড়ির চালক। তুরাগ থানার পুলিশ গতকাল জানায়, ডাকাতি হওয়া ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকার মধ্যে ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।