১৩ বছরে ৫১ মামলার রায়

ট্রাইব্যুনালের ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। মাঝে দুটি ট্রাইব্যুনাল হলেও এখন একটি। ট্রাইব্যুনাল বাড়ানোর ওপর জোর সংশ্লিষ্টদের।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
ফাইল ছবি

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত ১৩ বছরে ৫১টি মামলার রায় হয়েছে। বিচার ও প্রাক্‌-বিচার (তদন্ত শেষ হয়েছে) পর্যায়ে রয়েছে ৩৫ মামলা। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে করা ৪০টি আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী নৃশংসতা চালিয়েছিল। এসব অপরাধে তাদের সহযোগিতা করে বা নৃশংসতায় সরাসরি অংশ নেয় এ দেশীয় কিছু দোসর। এর মধ্যে ছিল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। 

স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। এ হিসাবে যাত্রা শুরুর ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ শনিবার। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচারকাজ। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪০টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যমতে, দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। তাঁদের মধ্যে ৪৪ জন পলাতক।

■ দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায়।

■ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ৪০ আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

■ বিচার ও প্রাক্‌-বিচার পর্যায়ে রয়েছে ৩৫ মামলা।

■ এ পর্যন্ত ছয়জনের ফাঁসিসহ সাত আসামির দণ্ড কার্যকর।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল প্রথম আলোকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ৩৫টি মামলার বিচার চলছে। এসব মামলার আসামি ২১৪ জন। এ ছাড়া সাত শর বেশি অভিযোগের তদন্ত চলছে। বেশি মামলা পরিচালনা ও বিচারপ্রার্থীদের আশাহত করতে না চাইলে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আপিল 

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ৪০টি আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ওই মামলায় সর্বশেষ শুনানি হয়। মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রায় দেন। রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ওই বছরের অক্টোবরে আবেদন করেন তিনি। আবেদন নিষ্পত্তির আগেই গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালের প্রিজন সেলে তিনি মারা যান। 

ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় দেন আপিল বিভাগ। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন তিনি। তাঁর আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। 

 জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপিল শুনানির জন্য বিচারক স্বল্পতা ছিল। এখন পর্যাপ্ত বিচারক আছেন। সম্প্রতি দুটি মামলা কার্যতালিকায় উঠেছে। দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি মামলার শুনানি শুরু হতে পারে।’

এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান, পটুয়াখালীর ফোরকান মল্লিক, বাগেরহাটের সিরাজুল হক ও খান মো. আকরাম হোসেন, নেত্রকোনার আতাউর রহমান ননী ও ওবায়দুল হক, কিশোরগঞ্জের সামসুদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জের মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া, মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়া এবং আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক আবদুল জব্বারের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল রয়েছে। 

তদন্ত কার্যক্রম ও আসামি

তদন্ত সংস্থার তথ্যমতে, এখন ১৭টি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে, যেখানে আসামি ২৬ জন। এর মধ্যে একটি অভিযোগের ক্ষেত্রে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ছয়জন এখনো পলাতক। অন্যান্য অভিযোগের আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৭৮৭টি, যার ৮৮টির তদন্ত শেষ হয়েছে। ২ হাজার ৮০৫ জনের বিরুদ্ধে ওঠা ৪৭১টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে তদন্ত সংস্থা।

তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সাফল্য ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে চূড়ান্ত বিচারে দণ্ডিতদের আপিলের নিষ্পত্তি না হওয়া এবং দেশে-বিদেশে পলাতক আসামিদের ধরতে না পারায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে হতাশা কাজ করছে।’

চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর দণ্ড কার্যকর 

ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে শীর্ষ পর্যায়ের সাত আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ছয় আসামি হলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।  

বিচারাধীন অবস্থায় দণ্ডিত আসামির মৃত্যু

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আপিল বিচার চলাকালে কয়েকজন দণ্ডিত আসামি মারা যান। তাঁদের আপিল অ্যাবেটেড (সমাপ্তি) ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। তাঁদের মধ্যে ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুস সুবহান, কিশোরগঞ্জের মোসলেম প্রধান, মৌলভীবাজারের রাজনগরের মো. আকমল আলী তালুকদার, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মাহবুবুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেন এবং আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিল্লাল হোসেন বিশ্বাস রয়েছেন। 

আপিল শুনানি না হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় ৪০টি মামলা আপিল শুনানির জন্য রয়েছে। কিন্তু শুনানি হচ্ছে না। সরকারের কোনো আগ্রহও দৃশ্যমান নয়। একদিকে গণহত্যাকারীরা শাস্তি না পেয়ে মারা যাচ্ছেন, অন্যদিকে শহীদ পরিবার বিচারের শেষ না দেখেই মারা যাচ্ছেন—বিচারে এই ধীরগতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।’ তিনি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল সচল করে বিচার দ্রুত শুরু করার ওপর জোর দেন।