চা–বাগানের কাজল এখন ‘ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার’
শীতের চা–বাগান ন্যাড়া চেহারার। পাতা ঝরে সবুজ হারিয়ে যায়। লালচে মাটির ভেতর থাকা ‘চম্পা লেকের’ পানি শুকিয়ে আসে। বাগান হয়ে যায় শ্রীহীন। চম্পা নামে স্থানীয় লোকজন ডাকে।
সবাই চেনে ভাড়াউড়া লেক নামে। যাহোক, প্রকৃতির সেই রুক্ষ সময়েই কিন্তু ‘ওরা’ আসে। আর বর্ষার বাগান একেবারে গাঢ় সবুজ। তখন বেশি দেখা যায় অন্যান্য প্রাণী।
শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এভাবে টুকটাক তথ্য দিচ্ছিলেন স্বল্পভাষী কাজল হাজরা। তাঁর ভাষায় ‘ওরা’ মানে পরিযায়ী পাখি। এর মধ্যে রয়েছে কালো বাজ, বড় খোঁপা ডুবুরি, ধুপনি বক, এশীয় শামুকখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, ধূসর টিটি, পাতিসরালির মতো অনেক পাখি।
ভাড়াউড়া চা–বাগানের কাজল হাজরা পাখি ও বন্য প্রাণীর ছবি তোলেন। বিপদগ্রস্ত বন্য প্রাণী উদ্ধার করে শুশ্রূষা দেন, পাখিদের জন্য গাছ লাগান এবং পরিবেশসচেতনতা তৈরিতে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা করেন।
সবই করেন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে। তাই কাজলের বাবা একটু অভিযোগের সুরে বললেন, ‘আমার ছেলে বনে মোষ চরায়।’
পরিযায়ী পাখির খোঁজে হাওরেও ছুটে যান কাজল। ছুটে যান বিপন্ন প্রাণী উদ্ধার করতে।
খুব ভোরে উঠে কোনো কোনো দিন বাগানে যাই। গিয়ে দেখি আমাদের আগেই কাজল ক্যামেরা হাতে নিয়ে বাগানে ঘুরছে। এত ধৈর্য ছেলেটার।রাজেন্দ্র হাজরা, চা–বাগানের শ্রমিক
কাজল আসলে প্রকৃতি–আচ্ছন্ন এক মানুষ। তাঁর সেকেন্ড হ্যান্ড নাইকন ডি ফাইভ হানড্রেড ক্যামেরায় কখনো ধরা পড়েছে শিকার নিয়ে উড়ে যাওয়া নীলকণ্ঠী, কখনো ছানাসহ সাঁতার কাটা সরালি গোত্রের মা হাঁস। অথবা ছবিতে উঠে এসেছে খাবার খেয়ে চলনশক্তিহীন ৮ ফুট দীর্ঘ অজগর।
দু–একবার কাজলের আলোকচিত্রী বন্ধুরা তুলে রেখেছেন সেসব সময়ের ছবি। দেখা যাচ্ছে তাঁর হাতে পাখির ছানা, মাথার ক্যাপে পাখি বসানো, কখনো হাতে সাপ। কাজলের হাতে বন্য প্রাণী ছাড়া আর একটা জিনিসই থাকে। সেটা তাঁর ক্যামেরা।
২০২০ সালে ক্যামেরাটি কেনার আগপর্যন্ত কাজলের একটা ছোট্ট পকেট ক্যামেরা ছিল। কয়েক বছর ধরে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছিলেন একটা ভালো ক্যামেরা কিনতে। এ সময় তাঁকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেঞ্জার্ড ওয়াইল্ড লাইফের (সিউ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী খোকন থৌনাউজম।
ভাড়াউড়া লেকে কালো বাজ, বড় খোঁপা ডুবুরি, ধুপনি বক, এশীয় শামুকখোল, কালামাথা কাস্তেচরা, ধূসর টিটি, পাতিসরালির মতো অনেক পরিযায়ী পাখি আসে শীতে।
খোকন থৌনাউজম প্রথম আলোকে বললেন, কাজল শুধু ছবি তোলেন এমন নয়। বিপন্ন বন্য প্রাণী বিপদে পড়েছে শুনলেই ছুটে যান তিনি। চা–বাগান আর শ্রীমঙ্গলের সড়কে প্রতিবছর তিনি গাছ লাগান। এ বছরও কাজল নিজের খরচে ৬০টির বেশি গাছ লাগিয়েছেন।
খোকন আরও বলেন, ‘সে থাকে চা–বাগানের কলোনিতে। চারপাশে সংগ্রামের পরিবেশ। কিন্তু কাজলের সংগ্রাম প্রকৃতি রক্ষা নিয়ে। ওর আগ্রহ দেখে যতটা সম্ভব পাশে থাকতে চেষ্টা করি।’
কাজল থাকেন শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা–বাগানের কলোনিতে। তাঁর বাবা ভানু হাজরা একসময় চা–বাগানের শ্রমিক ছিলেন। এখন নিজের একটি চায়ের দোকান আছে। মাত্র চার মাস বয়সেই মা মিনি হাজরাকে হারান কাজল।
এই পরিবারের আরেকটি গল্প আছে। কাজলের বাবার চায়ের দোকানে বসে শোনা হলো সে গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাড়াউড়া চা–বাগানে একসঙ্গে শ্রমিকদের দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। এতে প্রাণ হারিয়েছিলেন চা–বাগানের ৫০ জন।
কাজলের ঠাকুরদা মাংগুয়া হাজরা এবং ঠাকুরমা সনচারী হাজরাসহ এ পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছিলেন। সেদিনের হতাহতদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ আছে ভাড়াউড়া চা–বাগানে। সেখানে নাম লেখা পাওয়া গেল এই পরিবারের সদস্যদের।
তবে নিজের ব্যক্তিগত কথা বলতে খুব বেশি আগ্রহী নন কাজল। তাঁর কাছে যা–ই জানতে চাওয়া হয়, তিনি ঘুরেফিরে চলে যান বন, পাখি, বাগান আর বন্য প্রাণীর গল্পে। সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির একটি সহায়ক বইয়ে স্থান পেয়েছে বন্য প্রাণী সংরক্ষক হিসেবে বাহুতে বক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছবিসহ কাজল হাজরাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন।
ভাড়াউড়া চা–বাগানের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার আগেই ঝরে যায়। সেখানে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন কাজল।
১৩ ও ১৬ নভেম্বর ভাড়াউড়া চা–বাগানে কাজলদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে তখন রীতিমতো যুদ্ধ চলছে। সারি ধরে তৈরি মাটি আর আধা পাকা ঘরের বাসিন্দারা বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের জন্য যুদ্ধ করছেন। তখন সব ফেলে কাজল ছুটছেন আহত একটা পাখি উদ্ধার করে অভয়ারণ্যে ছাড়বেন বলে।
এভাবেই কাজল একদিন পেয়েছিলেন কালো বাজপাখির স্থির বসে থাকা দুর্লভ একটি ছবি। ঘটনাটি এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের। চা–বাগানে তখনো শীতকাল। একদিন ভোরে হাঁটতে হাঁটতে বাগানের কয়েক মাইল ভেতরে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল বাগানে কালো বাজপাখি এসেছে।
কালো বাজ বাংলাদেশে বিরল পরিযায়ী পাখি। শিকার ধরতে খুবই দক্ষ। এ কারণে সব সময় মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে। আলোকচিত্রের ভাষায় আই লেভেলে পাখির দেখা পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।
কাজল এরপর কয়েকবার চম্পা লেকের কাছে গেলেন বাজপাখির ছবি তোলার আশায়। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বসে থাকতেন ক্যামেরা হাতে নিয়ে। নিজের সাইকেলটা রাখতেন অনেকটা দূরে। যাতে শব্দে পাখি সতর্ক না হয়ে যায়। এরপর চা–গাছের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতেন পাখি থাকতে পারে এমন জায়গায়।
অবশেষে কাজলের অপেক্ষার পালা শেষ হয়। একদিন ভোর থেকে বসে আছেন ক্যামেরা হাতে নিয়ে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাজপাখিটা উঁচু গাছের ওপর চক্কর দিল কয়েকবার। তখনো কাজল স্থির। এরপর আস্তে আস্তে পাখিটা নেমে বসল গাছের নিচু ডালে। কাজল পেয়ে গেলেন তাঁর বহু প্রত্যাশিত কালো বাজপাখি।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবে কাজলের তোলা সেই ছবি পাঠানো হয়। বার্ড ক্লাবের সভাপতি জালাল আহমেদ ছবি দেখে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্ল্যাক বাজ শিকারি পাখি। এত কাছ থেকে এই পাখির ছবি সাধারণত তোলা যায় না। এই পাখির এত কাছের ছবি বাংলাদেশের অন্য কোনো আলোকচিত্রী তুলেছেন কি না, নিশ্চিত না। মানে আমার চোখে এখনো পড়েনি। কাজল হাজরার ছবিগুলোর ফোকাস ভালো, ফ্রেমিং সেন্স শার্প। তবে চারপাশে আরও একটু জায়গা রেখে ছবি তুললে ভালো হয়।’
কাজলদের চা কলোনিতে থাকেন রাজেন্দ্র হাজরা। তিনি চা–বাগানে ট্রাক্টর চালান। কাজলের ছবি তুলতে যাওয়ার সাক্ষী তিনি। কথায় কথায় বললেন, ‘খুব ভোরে উঠে কোনো কোনো দিন বাগানে যাই। গিয়ে দেখি আমাদের আগেই কাজল ক্যামেরা হাতে নিয়ে বাগানে ঘুরছে। এত ধৈর্য ছেলেটার!’
তবে কাজল ছবি তুলতে শুধু ধারেকাছের চা–বাগানেই যান তা নয়। কোনো পরিযায়ী পাখি এসেছে, খবর পেলেই ছুটে যান সিলেটের যে কোনো হাওর–বাঁওড়ে।
কাজল বলেন, ‘পরিযায়ী বিরল পাখির একটা ভালো ছবি তুলতে কখনো কখনো কয়েক দিন লাগে। পাখি মানুষের সাড়া পেলে উড়ে যায়। কখনো পানিতে নেমে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবু মনমতো একটা ছবি পেলে সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।’
একেক পাখি একেক ধরনের খাবার খায় বলে জানালেন কাজল। বললেন মাছ, সাপ, কেঁচো ও পোকা তাদের পছন্দের খাবার। কোনোটি পানি থেকে মাছ ধরে খায় আবার অন্যটি গাছ থেকে পোকা ধরে খায়। কেউ ফুল খায়, কেউবা খায় ফল। আবার কোনো প্রজাতির পাখি খায় ফুলের মধু। পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশ আবার জলচর।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজল ছবি তোলা শেখেননি। কিন্তু তাঁর হাতে উঠে আসছে অসাধারণ সব ছবি। কেমন করে ছবি তোলার নিয়মকানুন রপ্ত করলেন, জানতে চাইলে কাজল প্রথম আলোকে বললেন, ‘আগ্রহ থেকে দেখে দেখে শিখছি। ভালো না হলে একই পাখির ছবি তুলতে আমি আবার অপেক্ষা করি। আমাদের খোকন ভাই (খোকন থৌনাউজম) ভালো ছবি তোলেন। তাঁর ছবি তোলার কৌশল দেখি। তিনিও আমাকে পরামর্শ দেন।’
বন্য প্রাণীর ছবি তোলার পাশাপাশি বন্য প্রাণী উদ্ধার নিয়ে আছে কাজলের মাথাব্যথা। কোথাও কোনো প্রাণী বিপদে পড়েছে, জানলেই ছুটে যান তিনি। কাজল বললেন, ‘শীতকালে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হয় বাগানে। একদিন ভোরে পাখির ছবি তুলতে বাইক্কাবিলে গিয়ে দেখি এক মাছ বিক্রেতা পাখি ধরে নিয়ে যাচ্ছেন বস্তায় করে।
দুটি পাতি জলমুরগি আর অন্য একটি ধূসর টিটি। ওনাকে ছাড়তে অনেক অনুরোধ করলেও উনি রাজি হননি। পরে পাখিগুলো কিনে ছেড়ে দিই। তারপর তাকে পাখি শিকার করা সম্পর্কে কী শাস্তি হতে পারে, বুঝিয়ে বলি। একবার আমাদের গ্রামে প্রায় ৮ ফুট দীর্ঘ একটা অজগর সাপ ধরা পড়ল। কিছু একটা গিলে সাপটা নড়তে পারছিল না। মানুষ পিটিয়ে মারত। সাপটা উদ্ধার করে লাউয়াছড়া বনে নিয়ে ছেড়ে এসেছি। সবাইকে বুঝিয়েছি, অজগর সাপের বিষ থাকে না।’
এভাবে কখনো ডাহুক, কখনো প্যাঁচার বাচ্চা বা মহা বিপন্ন বনরুই উদ্ধার করে অভয়ারণ্যে নিয়ে ছেড়েছেন কাজল হাজরা।
ভাড়াউড়া লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাজল হাত তুলে দেখালেন কিছু গাছ। অনেক দিন ধরেই নিজের খরচে গাছ লাগাচ্ছেন। বললেন, ‘সাতছড়িতে (জাতীয় উদ্যান) আমাদের এখানকার চেয়ে বেশি পাখি আসে। খেয়াল করে দেখেছি, এর কারণ ওখানকার গাছ। কিছু নির্দিষ্ট গাছের ফুল পরিযায়ী পাখিকে আকৃষ্ট করে বেশি। এবার এই বাগানে এমন ৬০টি গাছ লাগিয়েছি। আর ১০ বছর পর এলে দেখবেন, আমাদের এই গাছগুলো বড় হয়েছে। আর সে জন্য অনেক রকম পাখি এখানে আসছে।’
ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন, জানতে চাইলে কাজল বললেন, একটা স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করতে পারলে ভালো হতো। সেই দলের মানুষ পর্যটক, গ্রামের মানুষসহ সবাইকে বুঝিয়ে বলবে পাখি ও বন্য প্রাণী শিকার না করার কথা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজল হাজরার তোলা ছবি ব্যবহার করে প্রতিবেদন হয়। স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদকেরা তাঁর কাছ থেকে ছবি চেয়ে ব্যবহার করেন। তবে প্রকাশের সময় তাঁর নাম ব্যবহার হয় না।
কাজল হাজরা এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে পড়াশোনা করেন। নাম শুনে বিবরণ দিতে পারেন পাখির। এমন করে জেনেছেন, ছবির সঙ্গে আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ থাকা কপিরাইটের প্রসঙ্গ।
এ নিয়ে আক্ষেপ আছে কি না, জানতে চাইলে কাজল প্রথম আলোকে বললেন, ‘নামটা স্বীকৃতি, ছবির সঙ্গে আলোকচিত্রীর নাম গেলে ভালো লাগে। যদি না–ও যায় আপত্তি নেই, বনের একটা প্রাণীর ছবি মানুষ দেখছে এতেই আমার আনন্দ।’
ব্যক্তিজীবনে অনেক সংগ্রাম আছে কিন্তু সব ফেলে সারাক্ষণ এই প্রকৃতি রক্ষার পেছনে ছুটছেন কেন, জানতে চাইলে ভাড়াউড়া চা–বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাজল বললেন, ‘মানুষ কি প্রকৃতি থেকে আলাদা? আমাদের প্রকৃতি, বন্য প্রাণী কত সুন্দর তাই ধরে রাখতে ছবি তুলি। এই সুন্দর দেখে যেন মানুষের প্রকৃতি রক্ষা করতে ইচ্ছা হয়। উপার্জন নিয়ে সারা জীবন ভাবার সময় আছে। প্রকৃতি নষ্ট হলে তাকে মেরামত করা কঠিন।’