থেমে গেল ৫৬ বছরের পথচলা

২০০২ সালে কাগজকলটি বন্ধ হলেও কিছু কর্মকর্তা ছিলেন। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এটি হস্তান্তর করা হয়।

  • গত ২১ জুলাই কাগজকলের সর্বশেষ দুই কর্মকর্তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়।

  • রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে কারখানার জমি হস্তান্তর।

  • ২০০২ সালে কাগজকলটি বন্ধ করে দেওয়া হলেও কিছু কর্মকর্তা ছিলেন।

পাকশী পেপার মিল এখন আর নেই। স্থানটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের আবাসনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। গত সোমবার বিকেলে
ছবি: হাসান মাহমুদ

রাষ্ট্রায়ত্ত নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের ৫৬ বছরের পথচলা থেমে গেল। গত ২১ জুলাই কাগজকল ছেড়ে গেছেন সেখানে কর্মরত সর্বশেষ দুই কর্মকর্তা। ফলে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীর এই কাগজকলে নিজস্ব আর কোনো জনবল রইল না।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তার কাজে ব্যবহারের জন্য নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের জমি নামমাত্র মূল্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দিচ্ছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এরই অংশ হিসেবে কাগজকল থেকে নিজেদের জনবল পুরোপুরি সরিয়ে এনেছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি)।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান শাহ্‌ মো. ইমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্ভবত দুই কর্মকর্তা চলে এসেছেন। কারণ, নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে জায়গা হস্তান্তর করা হয়েছে। তাঁদের সেখানে থাকার কোনো দরকার নেই। আমাদের সেখানে কিছুই নেই।’

নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের সর্বশেষ দুই কর্মকর্তা ছিলেন উপপ্রধান হিসাবরক্ষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও উপব্যবস্থাপক কাজী জয়নাল আবেদিন। সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুজন ছাড়াও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন।

গত ২১ জুলাই আমরা কারখানা ছেড়ে ঢাকায় বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ে যোগ দিয়েছি। আর দৈনিকভিত্তিক কর্মচারীদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে
মো. সিরাজুল ইসলাম, উপপ্রধান হিসাবরক্ষক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নর্থ বেঙ্গল পেপার মিল

২১ জুলাই আমরা কারখানা ছেড়ে ঢাকায় বিসিআইসির প্রধান কার্যালয়ে যোগ দিয়েছি। আর দৈনিকভিত্তিক কর্মচারীদের বিদায় করে দেওয়া হয়েছে।’

জানা গেছে, বিসিআইসির বোর্ড সভায় কাগজকল থেকে লোকবল সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইতিমধ্যে কারখানার কিছু যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হয়েছে। তবে এখনো কিছু অবিক্রীত রয়ে গেছে।

পাকশীর রূপপুর মোড় থেকে পশ্চিম দিকে ঈশ্বরদী ইপিজেড সড়ক ধরে এগোলেই রেললাইনের টানেল। এটি পার হয়ে ডানে তাকালেই চোখে পড়ে নর্থ বেঙ্গল কাগজকল। কারখানার মূল ফটকে লেখা ‘সংরক্ষিত এলাকা’। গত সোমবার গিয়ে অনুমতি না থাকায় ভেতরে ঢোকা যায়নি। বাইরে থেকে দেখা যায়, নতুন স্থাপনা তৈরির কাজ চলছে। পুরোনো একটি ভবন ছাড়া কাগজকলের আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

জানা যায়, পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ১৯৬৬ সালে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উত্তর পাশে ১৩৩ একর জমির ওপর এই কাগজকল গড়ে তুলেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয় ১৯৭৫ সালে।

২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন সরকার হঠাৎ কাগজকলটি বন্ধ করে দেয়। তবে সেখানে কারখানার কিছু কর্মকর্তা থেকে যান। পরে কাগজকলটি বিভিন্ন সময় চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও আর চালু হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সেখানে থাকতে শুরু করেন। তাঁদের স্থায়ী আবাসনের জায়গা দিতে কাগজকলটি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হলো।

পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাবিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ-ছয় মাস আগেও কাগজকলের স্থাপনা ছিল। তারপর ভাঙা শুরু হয়। এখন আর স্থাপনা নেই। জঙ্গল হয়ে গেছে। তবে এখনো কাগজকলের অফিসার কলোনি, গেস্টহাউস, মসজিদ আর বিদ্যালয়টি আছে।

হাবিবুল ইসলাম স্মরণ করে বলেন, কাগজকলে প্রায় এক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। তাঁদের পরিবার ছিল। কৃষক, কামার-কুমার, ভ্যানওয়ালা, দোকানপাট ধরলে অন্তত ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান ছিল এখানে। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা ছিল। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

নর্থ বেঙ্গল পেপার মিলের জমি বুঝে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জমি এখন পর্যন্ত নিবন্ধন করা হয়নি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের আবাসনের জন্য এখানে কিছু স্থাপনা হবে।

বিসিআইসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে আমরা নিবন্ধন দেব না। কারণ, আমাদের যে অর্থ দেওয়ার কথা, তার বড় অংশ এখনো বাকি। টাকা না দিলে আমরা নিবন্ধন দেব না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাও নিশ্চিত করে বলেন, দেনা-পাওনাসংক্রান্ত কিছু জটিলতা আছে। পেপার মিলের বিদ্যুৎসহ বেশ কিছু বিল বকেয়া রয়েছে। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ এসব বিল দিতে চায় না। তারা মনে করে, জমি নামমাত্র মূল্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হচ্ছে। তারাই বকেয়া বিল দিক। অথবা অর্থ বিভাগ বিষয়টি অন্যভাবে নিষ্পত্তি করুক।