কুতুবদিয়ায় ৬ বছরে পুকুরে ডুবে ২৯০ শিশুর মৃত্যু

নলকূপে পানি না ওঠায় পুকুর খনন বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে এমন পুকুর। যার অধিকাংশ ঘেরা–বেড়াহীন অরক্ষিত। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের হাজি মফজল মিয়া পাড়ায়প্রথম আলো

কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া উপজেলায় পুকুরে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রতি মাসে মারা যাচ্ছে একাধিক শিশু। গত প্রায় ছয় বছরে পুকুরে ডুবে মারা গেছে অন্তত ২৯০ জন।

উপজেলা প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৯৯ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের লোকসংখ্যা ১ লাখ ৫৭ হাজার। পরিবারের সংখ্যা ১৯ হাজর ৯০৫। পুকুর আছে ১৪ হাজারের বেশি। বলা যায়, যত বাড়ি, তত পুকুর। এর মধ্যে অন্তত ১০ হাজার ৪৫০টি পুকুর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।

সম্প্রতি উপজেলার কৈয়ারবিল, লেমশিখালী, উত্তরধুরুং, দক্ষিণ ধুরুং, আলী আকবরডেইল ও বড়ঘোপ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম ঘুরে অরক্ষিত পুকুরের চিত্র চোখে পড়েছে। এসব পুকুরের চারপাশে নেই কোনো ঘেরা বা বেড়া। শিশুরা সহজেই সেসব পুকুরে যেতে পারে।

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, শিশুমৃত্যু রোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সাঁতার শেখানোসহ কোনো ধরনের পদক্ষেপ সেখানে নেই। পরিবারগুলোও অসচেতন হওয়ায় বাড়ির পাশের পুকুরে বেড়া দেওয়া হয় না। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি হাসপাতালে যোগদানের কয়েক মাসে শিশুমৃত্যু রোধে ঘরে ঘরে গিয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে গত কয়েক মাসে শিশুর মৃত্যুহার কমে আসছে। আগে প্রতি মাসে সাত থেকে আটজন মারা গেলেও এখন দুই থেকে চারজনে নেমে এসেছে।

পুলিশ ও হাসপাতালের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছর ১১ মাসে উপজেলায় বিভিন্ন পুকুরে ডুবে ২৯০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৮০ জন, ২০১৯ সালে ৩৮, ২০২০ সালে ২৫, ২০২১ সালে ৪৭, ২০২২ সালে ৫৭ এবং ২০২৩ সালে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে মারা গেছে ৪৩ জন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, সম্প্রতি তাঁরা জরিপ চালিয়ে জানতে পারেন, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে পুকুরে ডুবে অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ওই সময় মায়েরা রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন ঘরে ভেতরে। তখন শিশুরা উঠানে খেলতে গিয়ে পুকুরের পানিতে নেমে বিপদে পড়ছে। দেরিতে হাসপাতালে আনা হয় বলে প্রাণেও রক্ষা করা যায় না।

ঘরে ঘরে মৃত্যুকূপ  

বাড়ির লাগোয়া এমন অরক্ষিত পুকুরে খেলতে খেলতে পড়ে যায় শিশুরা। সম্প্রতি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার লেমশিখালীতে
প্রথম আলো

৭ ডিসেম্বর কৈয়ারবিল ইউনিয়নের কৈলাইস্যাঘোনাতে পুকুরে ডুবে মারা গেছে সোহাগ মণি নামের আড়াই বছরের এক মেয়েশিশু। সোহাগ মণির বাবা আবদুল আলিম বলেন, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে উঠানে খেলতে খেলতে পুকুরের পানিতে নেমে পড়ে সোহাগ মণি। তখন পরিবারের লোকজন ঘরের ভেতরে ছিলেন। দেড় ঘণ্টা পর পুকুর থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

দ্বীপের পশ্চিম দিকে সমুদ্রসৈকতের পাশে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের হাজি মফজল মিয়া পাড়া, হাজি অছি মিয়া ও মৌলভি পাড়া। বেড়িবাঁধের পাশে অন্তত ৬০০ ঝুপড়ি। বাড়িগুলোর আশপাশে অন্তত ৫০০টি পুকুর। পুকুরে নেমে নারী শিশুরা গোসল করছেন।

ওই এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মীর কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আগে ১২০-২০০ ফুট নিচে সুপেয় পানি পাওয়া যেত। এখন ৮০০-৯০০ ফুট নিচে নলকূপ পুঁতেও সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির চাহিদা পূরণ করতে দরিদ্র লোকজন ঘরে ঘরে পুকুর খনন করে। সেখানে ডুবে শিশুরা মারা যাচ্ছে। মৃত্যু রোধ করতে হলে পুকুর ভরাট করতে হবে, নয়তো পুকুরের চারদিকে ঘেরা বেড়া দিতে হবে। কিন্তু দরিদ্র লোকজনের সেই সামর্থ্য নেই।

সাঁতার জানে না ৪০ হাজার শিশু

বড়ঘোপ ইউনিয়নের দিনমজুর খলিলুর রহমান বলেন, সাগরদ্বীপ উপজেলার চারপাশে বঙ্গোপসাগর এবং ঘরে ঘরে পুকুর থাকলেও উপজেলার ৪০ হাজারের বেশি শিশু সাঁতার জানে না। শিশুদের সাঁতার শেখানোর কোনো উদ্যোগ বা ব্যবস্থাও দ্বীপে নেই।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু রোধে হাসপাতালের পক্ষ থেকে করণীয় বিষয় তুলে ধরে ঘরে ঘরে লিফলেট বিতরণ, মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের সচেতন করা হচ্ছে। অরক্ষিত পুকুরগুলোতে  ঘেরা বেড়া দেওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।

গোলাম মোস্তফা আরও বলেন, পুকুরে ডোবা শিশুকে পানি থেকে তুলে মাথায় নিয়ে ঘোরানো, পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করা, ছাই বা লবণ দিয়ে শিশুর শরীর ঢেকে দেওয়া অথবা শিশুকে বমি করানোর চেষ্টা চালানো হয়। এসব করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়। হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হয়। পুকুর থেকে উদ্ধারের পর শিশুকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের সাঁতার শেখানো জরুরি। যদিও পুকুরে ডুবে নিহত শিশুদের অধিকাংশের বয়স ২ থেকে ৪ বছর।

সদ্য বদলি হওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিপংকর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু রোধে সচেতনতা এবং সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প রয়েছে। এ প্রকল্পে কুতুবদিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।