ফুটপাতের চায়ের দোকান কি ‘পাবলিক প্লেস’, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কি ঠিক বলেছেন

রাজধানীর লালমাটিয়ায় যেখানে গত শনিবার দুই নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, সেই জায়গায় গতকাল প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন নারীরা
ছবি: প্রথম আলো

দেশের আইনে জনপরিসর বা ‘পাবলিক প্লেসে’ ধূমপান নিষিদ্ধ। ধূমপান করা নিয়ে দুই তরুণীকে হেনস্তা ও মারধরের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ।

প্রশ্ন হলো, ফুটপাতের চায়ের দোকান কি জনপরিসর? দেখে নিই আইন কী বলে।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করা যাবে না। যদি এ বিধান কেউ লঙ্ঘন করেন, তবে ৩০০ টাকা অর্থদণ্ড হবে। পুনরায় একই অপরাধ করলে দ্বিগুণ হারে দণ্ড হবে।

পাবলিক প্লেস বলতে আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌবন্দর ভবন, রেলস্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময়-সময় ঘোষিত অন্য যেকোনো বা সব স্থান উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য যে আইনে ‘চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট’কে জনপরিসর হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যেসব খাবারের দোকান দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয়, সেগুলোকে জনপরিসর বলা হয়নি।

রাস্তার পাশের চায়ের দোকান জনপরিসরের আওতায় পড়বে কি না, জানতে চাইলে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এ বি এম জুবায়ের প্রথম আলোকে বলেন, আইনে সুনির্দিষ্ট করে চায়ের দোকানের মতো জায়গার কথা উল্লেখ নেই। তবে জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য স্থানের বিষয় উল্লেখ আছে। অর্থাৎ জনসমাগম স্থানে পরোক্ষভাবে ধূমপানের প্রভাব যেন না পড়ে।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি করা হয়েছে ২০০৫। শুরুতে এই আইনের প্রয়োগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। জরিমানাও করা হতো। তবে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, এখন আর এই আইনের প্রয়োগে সরকারের তেমন কোনো চেষ্টা নেই। এমনকি সচেতনতা কর্মসূচিও তেমন একটা দেখা যায় না।

অবশ্য দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্তোরাঁ, গণপরিবহনসহ আবদ্ধ জায়গায় ধূমপান করার প্রবণতা অনেক কমেছে।

জনপরিসরে ধূমপানের বিষয়টি সামনে এসেছে গত শনিবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় দুই তরুণীকে ‘হেনস্তা ও মারধর’কে কেন্দ্র করে। অভিযোগ উঠেছে, চায়ের দোকানে ধূমপান করা এবং কাপের অবশিষ্ট চা গায়ে ছিটিয়ে দেওয়ায় এক ব্যক্তি ও মব (একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা) দুই তরুণীকে হেনস্তা করে এবং একজনকে মারধর করা হয়। পরে পুলিশ দুই তরুণীকে হেফাজতে নেয়।

বিষয়টি নিয়ে রোববার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমি যতটুকু জেনেছি, তাঁরা (দুই তরুণী) নাকি সিগারেট খাচ্ছিল, কিছু লোক সেখান দিয়ে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। তারা (লোকেরা) বাধা দেওয়ায়, তাদের ওপর চা ছুড়ে মেরেছিল।’ তিনি বলেন, ‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ। তাই সবাইকে অনুরোধ করব, কেউ যেন উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান না করে।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
ফাইল ছবি

উপদেষ্টার এই বক্তব্যে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নারীর ওপর মবের মতো আক্রমণের ঘটনা জাস্টিফাই (ন্যায্যতা দেওয়া) করার অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার নারীদের মঞ্চ 'ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ'।

সংগঠনটি সোমবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণ দাবি করে। এতে প্রাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী লামিয়া ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মবের উসকানিদাতায় পরিণত হয়েছেন।

‘নির্যাতনের শিকার নারীরা যা করেছেন তা অপরাধ হলে সর্বোচ্চ সিভিল অফেন্স (দেওয়ানি অপরাধ) হয়; কিন্তু তাঁদের শারীরিক নির্যাতন করার ঘটনা একটি ক্রিমিনাল অফেন্স (ফৌজদারি অপরাধ)। একজন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কীভাবে একটা ক্রিমিনাল অফেন্সকে জাস্টিফাই করেন’, বলেন লামিয়া।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০১৫ –তে কোথায় ধূমপান করা যাবে, তা উল্লেখ করা আছে।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, ধূমপানমুক্ত এলাকাকে ধূমপান এলাকা থেকে আলাদা রাখতে হবে। ধূমপানমুক্ত এলাকায় যাতে ধূমপানের স্থানের ধোঁয়া প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য কোনো স্থান চিহ্নিত বা নির্দিষ্ট করা হলে সে স্থানের মধ্য দিয়ে কোনো অধূমপায়ীকে যেন যাতায়াত করতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ফুটপাতের চায়ের দোকানে ধূমপান করা আইনত অপরাধ কি না, সেটা দেখতে হবে। যদি অপরাধ হয়, তা দেখার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব যাঁর, তাঁকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, অজস্র পুরুষ প্রকাশ্যে ধূমপান করছেন। তাঁদের সঙ্গে কি এ ধরনের আচরণ করা হচ্ছে? পুলিশ যদি মেয়েদের রক্ষার্থে থানায় নিয়েও যায়, যাঁরা তাদের ওপর চড়াও হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এখানে বৈষম্যমূলক আচরণ হলো কি না, সেটা দেখতে হবে।

সারা হোসেন বলেন, লালমাটিয়ার ঘটনায় তরুণী যদি চা ছুড়ে মেরে থাকেন, সেটা কেন হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। আজ কোনো মেয়ের ধূমপান কারও ভালো লাগছে না, আরেক দিন হয়তো কারও শাড়ি পরা ভালো লাগবে না। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এসব বিষয়ে নজর দিয়ে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

‘যে তরুণ–তরুণীরা জুলাইয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে আন্দোলন করলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এ ধরনের আচরণ রুখে দাঁড়াবে’, বলেন সারা হোসেন।