ঢাকার হাসপাতালের আশপাশ ডেঙ্গুর জন্য বিপজ্জনক, কারণ কী

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা
ছবি: রয়টার্স

ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোর আশপাশে ডেঙ্গু ভাইরাসের ঝুঁকি বেশি। ঢাকার হাসপাতালগুলোয় ভর্তি ঢাকা মহানগরীর বাসিন্দাদের ৮৬ শতাংশের বেশির বাস হাসপাতালের দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে। ডেঙ্গু নিয়ে এ তথ্য ও শঙ্কার কথা উঠে এসেছে এবারের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব, রোগীদের বয়স, মৃত্যুঝুঁকি ও ভৌগোলিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে এক গবেষণাভিত্তিক সম্পাদকীয় নিবন্ধে। যুক্তরাজ্যের সাময়িকী ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিজে এটি ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বাসার কাছের হাসপাতালেই রোগী বেশি যায়। কিন্তু হাসপাতালের কাছাকাছি এলাকায় এত রোগী থাকার অর্থ, এসব এলাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি আছে। এ উপাত্ত থেকে ধারণা করা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই সম্ভবত হাসপাতাল থেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এটা প্রমাণ করতে রোগতাত্ত্বিক গবেষণা দরকার। হাসপাতালের এ তথ্য আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকা সেই গবেষণাকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলল।’

আরও পড়ুন
এডিস মশা।
ছবি: এএফপি

যুক্তরাজ্যের কেইল ইউনিভার্সিটির গবেষক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী নাজমুল হায়দার বিশ্লেষণমূলক এই সম্পাদকীয়তে নেতৃত্ব দেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ স্যার আলিমুদ্দিন জুমলা, দ্য চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের গবেষক শুই শান লি, বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দুই গবেষক মাহবুবুর রহমান ও আহমেদ রায়হান শরীফ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এমআইএসের প্রধান ডা. শাহ আলী আকবর আশরাফী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের মোহাম্মদ নাইম হোসেন ও যুক্তরাজ্যের স্টাফোর্ডশায়ার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান।

এ গবেষণায় মূলত সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া ডেঙ্গু রোগসংক্রান্ত গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৭ আগস্টের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকার ৭৭টি হাসপাতালের তথ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নথিভুক্ত করে। দেখা গেছে, এসব হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৫৬ শতাংশ ঢাকার বাসিন্দা। বাকি ৪৪ ভাগ ঢাকার বাইরের। ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ৮৬ শতাংশের বসবাস হাসপাতালের দুই কিলোমিটারের মধ্যে। হাসপাতালের কাছাকাছি ডেঙ্গু ভাইরাসের রোগীর উচ্চ ঝুঁকি রয়ে গেছে।

কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণক্ষমতা পিরিয়ড গড়ে চার থেকে পাঁচ দিন। তবে সর্বোচ্চ ১২ দিন পর্যন্ত একজন রোগীর দেহে এই ভাইরাস সংক্রমণক্ষম থাকতে পারে।

আরও পড়ুন
বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১১ আগস্ট
ফাইল ছবি প্রথম আলো

গবেষক নাজমুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অবস্থায় একজন রোগীকে একটা মশা কামড় দিলে সে মশা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত মশার সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে হাসপাতালের কাছাকাছি স্থানগুলায় ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণের একটা নিবিড় সংক্রমণ চক্র গড়ে ওঠে। তাই এই হাসপাতালগুলোর কাছাকাছি এলাকায় বসবাসকারী মানুষের ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।’

গবেষণাটিতে যেভাবে হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাধিক্যের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে জরুরি নজরদারি দরকার। সেটা আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে
রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমদ

আগের বছরগুলোর মতোই এবারও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ব্যাপক হারে শুরু হওয়ার সময় ঢাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল। তবে জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে; যদিও মৃত্যুর সংখ্যা ঢাকাতেই বেশি। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগের জীবাণু বহনকারী এডিস মশার বিস্তার অনেক বেশি। আগস্ট মাসের শেষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার করা জরিপে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার দুই সিটির বাসাবাড়িতে এবারই এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট সবচেয়ে বেশি। লার্ভার ঘনত্বও আগের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি। মশা জরিপের এ ফলাফলই বলে দিচ্ছে, দুই সিটির চিরুনি অভিযান বা ক্রাশ প্রোগ্রামে আসলে কাজ হচ্ছে না। রোগী কমলেও ঢাকায় ডেঙ্গু বিস্তারের ঝুঁকি তাই এখনো বেশি।

কীটতত্ত্ববিদ ও চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণক্ষমতা পিরিয়ড গড়ে চার থেকে পাঁচ দিন। তবে সর্বোচ্চ ১২ দিন পর্যন্ত একজন রোগীর দেহে এই ভাইরাস সংক্রমণক্ষম থাকতে পারে।

হাসপাতালগুলোর কাছাকাছি ডেঙ্গু রোগের বিস্তার নিয়ে এই গবেষণার ফলাফলকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম। তিনি গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালগুলোর ভেতরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই করে। কিন্তু প্রতিটি হাসপাতাল তো সিটি করপোরেশনের আওতাধীন। এর আশপাশে মশার বিস্তার রোধের কাজটি তাদেরই দায়িত্ব। সেই কাজ ভালোমতো করা গেলে মশার বিস্তার কমবে, রোগও কমবে।

আরও পড়ুন

হাসপাতালের আশপাশে শুধু নয়, খোদ হাসপাতালও ডেঙ্গু সংক্রমণের কেন্দ্র হতে পারে—এমন আশঙ্কা মুশতাক হোসেনের।

ঢাকার যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, সেখানে অনেক চিকিৎসক ও নার্স ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকার গুলশানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গত সপ্তাহে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ওই হাসপাতালের পাঁচ চিকিৎসক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।

রাজধানীর যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি, সেগুলোর বেশির ভাগই পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। এখানে এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। এরপর আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল। দুই হাসপাতাল মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে আগস্টের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী ছিল যাত্রাবাড়ী ও সবুজবাগে। দুটি এলাকাই দক্ষিণ সিটির মধ্যে পড়েছে।

দক্ষিণ সিটির কিছু এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাধিক্য এবং হাসপাতালে ভর্তির চিত্রের মধ্যে একটা সাযুজ্য আছে বলে মনে করেন রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘গবেষণাটিতে যেভাবে হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাধিক্যের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে জরুরি নজরদারি দরকার। সেটা আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।’

হাসপাতালের আশপাশে ডেঙ্গু রোগী বেশি থাকার বিষয়টি তাঁদের ভাবনার মধ্যে আছে বলে জানান দক্ষিণ সিটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবীর। তবে তাঁর বক্তব্য, ‘হাসপাতালের আশপাশে ৮৬ শতাংশ লোকের বাস—এ সংখ্যা বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু আশপাশে রোগী যে আছে, সেটা মাথায় রেখেই মশা নিধন এবং পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে।’

গবেষক নাজমুল হায়দার অবশ্য বলেন, ‘প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে আমরা হাসপাতালে রোগী ভর্তির এ চিত্র পেয়েছি। এখানে ভুল থাকার অবকাশ নেই। রোগীদের দেওয়া ঠিকানার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকতে পারে।’