প্রথম আলোর গোলটেবিল
সরকারের ভেতর আরেক সরকার
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে যেসব কাজ দরকারি ছিল, সরকার তার উল্টো যাত্রা করেছে।
সরকারে কেতাবি যোগ্যতার সমাহার থাকলেও সক্ষমতায় ধস নেমেছে।
ভয় বিচারব্যবস্থার ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এক বছরে ভালো অভিজ্ঞতা কম, খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি। অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে সক্ষমতার অভাব প্রকট। সরকারের ভেতর আরেকটা সরকার আছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাদের আলোচনায় মোটাদাগে এমন মতামত উঠে এসেছে। গতকাল বুধবার ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজন করে প্রথম আলো।
বৈঠকে কেউ কেউ বলেন, এখন দ্রুত নির্বাচনই সমাধান। সেই নির্বাচন করতে হলে সেনাবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতা লাগবে।
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় শোক জানানো হয়। সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
অনুষ্ঠানে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বিপ্লবী সরকার গঠনের পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁর মতে, গত বছর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে সবকিছু শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে চলে গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করা হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান বহাল তবিয়তে আছে। আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়—সবই আগের জায়গায় আছে, কিছুই পরিবর্তন হয়নি।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘অবশ্যই গণ–অভ্যুত্থান পথ, নির্বাচন না। নির্বাচন করার মানে হচ্ছে, ওই পুরোনো লুটেরা মাফিয়া শ্রেণিকে আবারও আনবেন। ঠিক এনসিপিও (জাতীয় নাগরিক পার্টি) সেটাই শিখছে। হ্যাঁ, নির্বাচনই করতে হবে। ওরাও ঠিকই চাঁদা চাইতেছে, বড় বড় হাউসের কাছে যাচ্ছে। দুই কোটি টাকা, পাঁচ কোটি টাকা।’
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদদের ঐক্যের ওপর জোর দেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গঠন করতে পারব। সেটা সহজ হবে যখন নিজেদের মতপার্থক্য দূর করতে পারব।’
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার উল্টো যাত্রা
শুরুতে বক্তব্য দেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে যেসব কাজ দরকারি ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার তার উল্টো যাত্রা করেছে। ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বা লিঙ্গের নামে বৈষম্যবাদী রাজনীতি ও দর্শন যাঁরা ধারণ করেন, তাঁদের দাপট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারাই এই অভ্যুত্থান করেছে।
আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষের বড় অংশগ্রহণ ছিল জানিয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, গত এক বছরে এই মানুষগুলোকে বারবার রাস্তায় নামতে হয়েছে। অথচ জুলাইয়ে আন্দোলনের মূল বিষয়টি ছিল কর্মসংস্থান।
আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে অনেকগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে। সেটা তাদের উল্লেখযোগ্য কাজ। কিন্তু কমিশনের প্রতিবেদনগুলোর মধ্যে শুধু সংবিধান ছাড়া আর কোনো প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মনোযোগ নেই। সংবিধান সংস্কার কমিশন নিয়ে একমাত্র আলোচনা হচ্ছে, সেখানে সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজনের একমাত্র আগ্রহ সংবিধানের মধ্যে এমন পরিবর্তন, যাতে তাঁদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিদেশিদের সঙ্গে সরকার চুক্তি করার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, কোনো আলোচনা ছাড়া স্টারলিংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এই সরকার অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অবশ্য এর উদাহরণ একমাত্র স্টারলিংক ছাড়া আর কেউ দেখেনি।
পাওনার হিসাব এখন মূল কথা
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি সামনে রেখে তার কার্যক্রম নিয়ে শক্ত কথা বলার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মিষ্টি কথা, ভালো কথা, ভালো উদ্যোগ ইত্যাদি অনেক কিছু হয়েছে। আমরাও অনেক ধরনের আশাপ্রদ, অনেক কিছু দেখেছি। বিচার, সংস্কার, নির্বাচন—এ বিষয়গুলোতে এক বছরে কী কী হলো, সেই পাওনার হিসাবটা আজকে মূল কথা হতে হবে।’
বর্তমানে সাধারণ মানুষকে গণনার বাইরে ফেলে দেওয়া হয়েছে এবং এ জন্য মানুষ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন হোসেন জিল্লুর। তিনি বলেন, মানুষকে দর্শক থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীর পর্যায়ে আবার নিয়ে আসতে হবে। সেটার একটা মাধ্যম নির্বাচন।
সরকারে কেতাবি যোগ্যতার সমাহার থাকলেও সক্ষমতায় ধস নেমেছে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়, নীতিনির্ধারণ, দর-কষাকষি—প্রতিটা ক্ষেত্রেই সক্ষমতার ধস দেখা যাচ্ছে। সক্ষমতার এই ধস পাল্টাতে হবে। শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও বেকারত্বের অবস্থা ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত বছর ডিসেম্বরের পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি পূর্ণোদ্যমে ফিরে এসেছে। আমলা কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গভাবে জেঁকে বসে আছে।
কাগুজে ঐকমত্যের প্রক্রিয়া সরাসরি জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন হোসেন জিল্লুর রহমান।
সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী চেতনায় আমরা নতুন সরকার আনলাম। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী চেতনাকে তারা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রতিফলন করতে পারল না।’
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে আরেকটা সরকার আছে বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘এখন সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্নটা বিশেষ করে দলীয় নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। কারণ, এখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে যে আমরা সরকার বলতে যাদের দেখি আনুষ্ঠানিকভাবে, আসলে তার ভেতরেও আরেকটা সরকার আছে। এটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। এটা সবার কাছেই প্রকাশ্য। এখন সরকারের নিরপেক্ষতা পুনঃপ্রমাণ করা...কাদম্বরীকেই করিতে হইবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেও এখন একটা ভালো নির্বাচন করতে পারবে কি না, বৈঠকে সেই প্রশ্ন রেখে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আপস, আঁতাত বা সিট ভাগাভাগির নির্বাচন নয়, একটা প্রকৃত নির্বাচন দরকার, যেখানে মানুষ ভোট দেওয়ার পর শান্তিতে থাকবে।’
ভালো নির্বাচন করতে হলে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমরা খুব ভালো বুঝেছি যে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও প্রচলিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এটা করা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর বৃহত্তর অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে এটা করা সম্ভব হবে না।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সবশেষে বলেন, ‘গত বছরের মূল্যায়নের চেয়ে আমি আগামী এক বছরের এই নিষ্ক্রমণ পদ্ধতিটা কী হবে বা এক্সিট পলিসিটা কী হবে, সেটার জন্য কী কী প্রয়োজন পড়বে, সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার আমি প্রয়োজন বোধ করেছি।’
ভয়ের পরিবেশ বিরাজমান
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বক্তব্যের শুরুতে উল্লেখ করেন, মানুষ এখন কথা বলতে পারছে। তবে বিচার বিভাগে ভয় রয়ে গেছে।
সারা হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন কোনো ভয়ভীতি নেই, এমনটা কেউই বলতে পারবে না। ভয় বিচারব্যবস্থার ভেতরেও আছে, বাইরেও আছে। বিচারপতিদের সবারই চিন্তা হচ্ছে, আমি কী করলে, কে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কোনো একটা গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে কিছু একটা নিয়ে জোরে আওয়াজ তুললেই তো শেষ। সে বিচারপতির আর কোনো ভবিষ্যৎই থাকবে না। এমন ভয়ের পরিবেশে কে ঠিকমতো রায় দেবে বলুন? রায় তো দূরের কথা, আদেশই-বা কে দেবে?’
জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে সারা দেশে গণহারে করা ঢালাও মামলার বিষয়ে সারা হোসেন বলেন, ঢালাও মামলা সাংঘাতিক লজ্জার ব্যাপার। সরকার এ ব্যাপারে গাঁ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সরকার বলছে তারা মামলা করেনি, জনগণ করেছে। কিন্তু সরকার পক্ষের আইনজীবীরা তো আদালতে বলেন না যে এটা ঠিক হয়নি। নিরপরাধ যাঁরা ১০ মাস ধরে কারাগারে আটক আছেন, তাঁদের ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার দায় কিন্তু তাদেরই।
ইতিবাচক দিক আছে, তবে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে ভালো অভিজ্ঞতা অল্প, খারাপ অভিজ্ঞতাই বেশি—এ কথা উল্লেখ করে লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেছেন, স্বল্প দক্ষ বা অনেকটাই অদক্ষ একটা সরকারের অধীনে ১২ মাস থাকার দুঃখ গত এক বছরে মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই প্রথম ফেসবুকের দিকে তাকিয়ে সরকার পরিচালনার একটা সংস্কৃতি দেখলাম এবং জনতুষ্টিবাদের কাছে বারবার আত্মসমর্পিত হতে দেখলাম। সমাজজুড়ে বিপজ্জনকভাবে সুনামির মতো একটা দক্ষিণপন্থী মনোভাবের বিস্তার ঘটেছে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ‘মব’ (উচ্ছৃঙ্খল জনতা) সহিংসতা বেড়েছে।
বৈঠকে আলতাফ পারভেজ গত এক বছরের কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তরুণ-তরুণীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতিমনস্ক হয়েছে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের আলাপটা ৫০ বছর পর বাংলাদেশের মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে রাজনীতির ক্ষেত্রে। এটা একটা ভালো দিক।
চলমান সংস্কার কার্যক্রম প্রসঙ্গে এই গবেষক বলেন, ১১টি সংস্কার কমিশন হলো টাস্কফোর্স হলো। কিন্তু ঐকমত্য কমিশন হলো মাত্র ছয়টি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে। এমন কেন হলো, এটা একটা বড় প্রশ্ন।
তরুণদের ভয় কেটে যাওয়ায় ভবিষ্যতে কোনো স্বৈরাচারী সরকার আসা কঠিন বলে উল্লেখ করেন আলতাফ পারভেজ। তিনি আগামী সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না পাওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিরোধী দল দুর্বল হলে, ছোট হলেও কী হয়, অতীতে দেখা গেছে। এটা একটা বিপর্যয়।
নতুন পথে হাঁটেনি
রাজনৈতিক নেতারা কোনোভাবেই নতুন কোনো পথে হাঁটেনি বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) সহ-উপাচার্য সাঈদ ফেরদৌস। তিনি বলেন, অনেকে বলতে পারেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) পুরোনো কায়দায় হাঁটছে। কিন্তু বিএনপি কি নতুন পথে হাঁটছে? জামায়াত কি কোনোভাবে নতুন পথে হাঁটছে? সেই তো চ্যানেল দখল, সেই তো ব্যাংক দখল।
তরুণ নেতৃত্বের ব্যাপারে সাঈদ ফেরদৌস বলেন, তাঁরা হয়তো ব্যবসার জন্য দু-তিন লাখ টাকার পুঁজি খুঁজছিলেন। অথচ তাঁদের কোটি টাকা দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে তাঁদের দুর্নীতিগ্রস্ত করল? জুলাই নেতৃত্বের গায়ে দাগ লাগিয়ে দেওয়া, তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত করা, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। আমি বলছি না যে তাদের কোনো এজেন্সি নাই, তারা মাসুম বাচ্চা বা তাদের গায়ে অন্যরা দাগ লাগিয়ে দিচ্ছে।
গণ-অভ্যুত্থানে রিকশাচালক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, তাঁদেরকে এখন আর কোনো আলোচনায় দেখা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন কামার আহমাদ সাইমন। তিনি বলেন, উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষের মতো জটিল বিষয় নিয়ে হাস্যকর বিতর্ক চলছে। কে কয়টা আসন বিক্রি করবে, কাকে কত ভাগ দেবে এটা মূল বিষয়। যে রিকশাচালক অভ্যুত্থানে আহত-নিহত ব্যক্তিদের তুলল, অভ্যুত্থানের পর তাঁর রিকশা ভেঙে দেওয়া হলো। কেউ পাশে দাঁড়াল না।
অভ্যুত্থানে শ্রমজীবীরা সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন জানিয়ে উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা বলেন, ‘সেই শ্রমিকদের ওপর গত আগস্টে গুলি চালানো হলো। অভ্যুত্থানের ন্যূনতম চাওয়া ছিল গুলি চলবে না। কিন্তু প্রথম শহীদ হলেন চম্পা নামের গার্মেন্টস শ্রমিক। সে সময় অনেক কারখানা বন্ধ হলো, বেতন বন্ধ হলো। শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে এলেন। এ ব্যাপারে সরকারের কোনো বিকার ছিল না।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী কিছু নিয়ে সমালোচনা করলে তকমাবাজি করা হচ্ছে মন্তব্য করে মাহা মির্জা বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে দ্বিমত করলে, এনসিপি নিয়ে কিছু বললে অভ্যুত্থানের পক্ষে যারা ছিল, তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে। এটা দুঃখজনক।’
জুলাই উদ্যাপন নিয়ে কথা বলেন মাহা মির্জা। তিনি বলেন, ‘নরম্যান ফ্লিনকেইনস্টেইন নামের একজন লেখক বলেছেন, হলোকাস্টকে (ইহুদি হত্যা) উদ্যাপন করতে করতে জায়োনিস্টরা ইন্ডাস্ট্রি বানিয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে উদ্যাপন করতে করতে সেটাকে ইন্ডাস্ট্রি বানানো হয়েছে। জুলাইকে উদ্যাপন করতে করতে যেন জুলাইকে ইন্ডাস্ট্রি না বানিয়ে ফেলি।’
ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সব আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়া জরুরি বলে মনে করেন তরুণ গবেষক সহুল আহমদ। তিনি বলেন, দেশের বিচারব্যবস্থায় যে ভিকটিম (ভুক্তভোগী), সে-ই আসলে ভিক্টর (বিজয়ী পক্ষ)। যে যখন ক্ষমতায় থাকে, সে–ই তখন বিচার পায়। যে পক্ষ হেরে যায়, সে বিচারের দাবিই করতে পারে না। তিনি বলেন, ‘সেদিক থেকে দেখলে মোটাদাগে আমরা আসলে ন্যায়বিচারের দিকে যেতে পারিনি। কিন্তু এভাবে সমাজ এবং রাষ্ট্রে আরও ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে, যা অপূর্ণ রেখে সামনে এগোনোর কথা ভাবা যায় না।’
অভ্যুত্থানে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পাশাপাশি অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষতগুলো পূরণের ওপরও জোর দেন সহুল আহমদ।
বিগত এক বছরের অর্জনের কথা উল্লেখ করে সহুল আহমদ বলেন, ‘এই প্রথম আমরা নিজেরা নিজেদের সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাধীনভাবে মতামত রাখতে পারছি। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোনো ভয় না থাকলেও কিঞ্চিৎ সামাজিক ভয় যুক্ত হয়েছে আমাদের মধ্যে।’
নির্বাচনই ভালো সমাধান
এখন নির্বাচন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। নির্বাচনকে খাটো করার প্রবণতা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা অদ্ভুত সমস্যার মধ্যে আছি—গণতন্ত্র চাই। কিন্তু নির্বাচন চাওয়া যাবে না। এখন নির্বাচনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার বা নির্বাচনকে বিলম্বিত করার একটা চেষ্টা আছে। নির্বাচন পিছিয়ে দেশ যদি গোল্লায়ও যায়, কিছু মানুষের লাভ আছে।’
জাহেদ উর রহমান মনে করেন, দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে বেশ কিছু শক্তি চায় বাংলাদেশ একটা মোটামুটি নৈরাজ্যকর অবস্থায় যাক। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন নির্বাচন ছাড়া আসলে আর কোনো উপায় নেই। এটা প্রতিটি জায়গা থেকে বলতে হবে।’