ধর্ষণ, নিপীড়ন, অসমতা, অন্যায্যতা, পিতৃতন্ত্র, শ্রমের অবমূল্যায়ন, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছেন নারী–পুরুষ সবাই। ‘নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা’ ব্যানারে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে স্লোগানে, গানে, পদযাত্রায় এ আওয়াজ ওঠে। ঘোষণাপত্রে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টাকে মেনে না নেওয়ার স্পষ্ট অবস্থানের কথা জানানো হয়।
লড়াই অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমরা সরকার ও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নারীবিষয়ক অবস্থানকে নজরদারিতে রাখব। যে ক্ষমতাকাঠামো জুলুমবাজি জিইয়ে রাখে, সেই কাঠামো ভাঙব। আমরা চুপ করব না, হুমকির মুখে নত হব না। অধিকার আদায়ের দাবিতে অটল থাকব। ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে হাল ছাড়ব না।’
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম ৩ মে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করে। সমাবেশে কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করার পর নারীর ডাকে মৈত্রীযাত্রা ব্যানারে এ অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দেন বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠকেরা। অনুষ্ঠানের জন্য ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ বা গণচাঁদার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। গত কয়েক মাসে নারীদের পোশাক নিয়ে, ধূমপান করা নিয়ে মব তৈরি করে মারধর, হামলা, অশালীন মন্তব্যের একের পর এক ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারী অধিকারকর্মীরা গতকাল বড় সমাবেশের আয়োজন করলেন। এর আগে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার আট বছরের শিশুটির জন্য শিক্ষার্থীরা পথে নেমে এসেছিলেন।
ঘোষণাপত্রে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান এবং এ নিয়ে সরকার নিশ্চুপ রয়েছে উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। নারীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও তারা বাধা তৈরি করছে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা এবং অনলাইনে হয়রানি করে রাজনৈতিক পরিসরে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করার তৎপরতা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। বিভিন্ন স্থানে অতর্কিত হামলা, আন্দোলনে বাধা, পরিকল্পিত মব-আক্রমণ, মোরাল পুলিশিং, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণ, প্রকাশ্যে মারধর এবং নানা ধরনের হুমকি প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
গতকালের আয়োজনে কোনো বক্তৃতা ছিল না। কোনো সংগঠনের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। জমি, ঘর, উত্তরাধিকার, সবার চাই সমান অধিকার/ ঘরে, বাইরে, প্রতিষ্ঠানে ব্যাটাগিরি চলবে না/ জবাব চাই ন্যায্যতার/ মিছিলে নারী মুখ চাই, মিছিল শেষে কেন নাই, মিছিলে নারীমুখ চাই, রাষ্ট্র গঠনে কেন নাই/ পুরুষতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক/ অধিকারের প্রশ্নে সমাঝোতা হবে না/ পাহাড় থেকে সমতলে, লড়াই হবে সমানতালে ইত্যাদি স্লোগান, ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন নারী ও পুরুষেরা।
বেলা তিনটার আগে থেকে সমাবেশস্থল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে সমবেত হতে থাকেন নারীর সমতার পক্ষে নারী–পুরুষেরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। সমাবেশস্থলে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ, মাদ্রাসায় ধর্ষণ বন্ধ, নারীর সমতা, পাহাড়ে নির্যাতন বন্ধ, চা–বাগান, পোশাকশিল্প থেকে সব শ্রমিকের সমমজুরি, গৃহকর্মের মর্যাদা, চোখের সংযম কোথায় এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকারের দাবি–সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান নারী–পুরুষেরা।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ড্রাম মিউজিকের পর উদ্দীপনামূলক গান পরিবেশন করা হয়। নারীর প্রতি অবিচার, নারীর চলাচলে বাধা, নারীর পোশাক নিয়ে অশালীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নানা কথন তুলে ধরেন দুই নারী। ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’, ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’, ‘এক সাথে এক সঙ্গে বাঁচি’সহ পাহাড়ের গান, চা–বাগানের গান পরিবেশন করা হয়।
এরপর ঘোষণাপত্র পাঠ করেন তিনজন। তাঁরা হলেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা সামসি আরা জামান, শহীদ মামুনের স্ত্রী শারমিন আক্তার ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি জয়ন্তী চাকমা।
হাজারো নারী–পুরুষের অংশগ্রহণে বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে পদযাত্রা শুরু হয়। পদযাত্রাটি মানিক মিয়া থেকে ফার্মগেট ঘুরে সমাবেশস্থলে ফিরে আসে।
অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক, মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির ও শীপা হাফিজা, অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আইনজীবী সারা হোসেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম ও মাসুদা রেহানা বেগম, জেন্ডার–বিশেষজ্ঞ ফৌজিয়া খন্দকার, সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, লেখক–গবেষক মাহা মির্জা, অভিনয়শিল্পী আজমেরী হক বাঁধনসহ অনেকে।
নারী মৈত্রীযাত্রার আয়োজন সম্পর্কে আয়োজকেরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও ফেসবুক পেজে জানিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান আক্রমণ, বৈষম্য ও অন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মৈত্রীযাত্রার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়েছে। আয়োজনের সঙ্গে রয়েছেন দীর্ঘ সময় ধরে নারী অধিকারের জন্য লড়ে যাওয়া নারী সংগঠনসমূহ, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। অংশ নেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী, শ্রমজীবী মানুষ, দলিত নারী, প্রতিবন্ধী, পোশাকশ্রমিক, চা–শ্রমিক, গৃহকর্মী, গৃহিণীসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ।
ঘোষণাপত্রে যা বলা হয়েছে
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘চব্বিশের অভূতপূর্ব জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আজ আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আমাদের দাবি, একটি গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ, যেখানে সব মানুষের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে বৈষম্যবিরোধিতা ও সাম্যের যৌথ মূল্যবোধের ওপর। আজকে আমরা দাঁড়িয়েছি এ আকাঙ্ক্ষাগুলো নিয়েই, যেগুলো ছিল দীর্ঘ নারী আন্দোলন ও জুলাই অভ্যুত্থানের লড়াইয়ের কেন্দ্রে। বাংলার ইতিহাসের পরিক্রমায় আমরা দেখে এসেছি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা, টঙ্ক, নানকার থেকে শুরু করে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর গণ–অভ্যুত্থান, ফুলবাড়ী ও কানসাট আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে নারীসহ আমাদের সবার সাহসী ভূমিকা। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও নারীসহ অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এ অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।’
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন শ্রমজীবী নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ নারীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৪৩৩টি সুপারিশ পেশ করে। কিন্তু আমরা দেখেছি, প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক অধিকার–সংক্রান্ত সুপারিশগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গিয়ে এবং গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ না রেখে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে। জনসমক্ষে কমিশনের সদস্যদের জঘন্যভাবে অবমাননা করা হয়েছে, কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘আমরা চাই, নিপীড়িত নারীর বিচার পাওয়ার, মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। আমাদের লক্ষ্য, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ও সব অর্থে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। মৌলিক নীতিগুলোর অধিকাংশই নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন উপস্থাপন করেছে। ফলে এই কমিশন বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ও কুৎসিত প্রচারাভিযান অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
ঘোষণাপত্রে কিছু দাবি উল্লেখ করে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে, বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার হুমকি, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ঘিরে গুজব ও অপপ্রচার এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আতঙ্ক সৃষ্টির বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। নারী ও প্রান্তিক জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে অন্তর্বর্তী সরকারকে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে আয়োজন নিয়ে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আয়োজকদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। নারীর বিরুদ্ধে যে ন্যক্কারজনক ও বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ প্রকাশিত হচ্ছে, তার প্রতিবাদ করেছেন এ প্রজন্মের নারীরা। তাঁরা ঠিকভাবেই তুলে ধরেছেন যে কমিশনের প্রস্তাবকে অন্যদিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কারও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করিনি। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করে তা ঐচ্ছিক রাখার কথা বলেছে কমিশন, যাতে যাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন নয়, সমতার ভিত্তিতে সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, বিবাহ, অভিভাবকত্ব, ইত্যাদির ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ চান, তাঁদের জন্য ব্যবস্থা থাকে। আর যাঁরা ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থাকতে চান, তাঁরা তাঁদের মতো ব্যবস্থা নিতে পারেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে শিরীন পারভিন হক বলেন, ‘আমরা আলোচনা–সমালোচনা, তর্কবিতর্ক—সবকিছুকেই স্বাগত জানাই। কিন্তু গালিগালাজ গ্রহণযোগ্য না।’