বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং ‘তিন শূন্য প্রতিশ্রুতি’

উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার তদারকি ও মূল্যায়ন জরুরি। উন্নয়নের ভিত্তিমূলে থাকতে হবে অধিকার, পছন্দ ও সমতা।

উন্নয়নের লক্ষ্য হলো সব মানুষের জীবনের গুণগত মানের উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগত বা পরিমাণগত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে গুণগত অবস্থার দিকে এগোনো জরুরি।

১৯৯৪ সালের ৫–১৩ সেপ্টেম্বর মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক ঐতিহাসিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন (আইসিপিডি) ছিল জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ভাবনায় এক ‘প্যারাডাইম’ শিফট বা পরিবর্তন। জনসংখ্যার পরিমাণগত আকারের পাশাপাশি জনসংখ্যার গুণগত উন্নয়নও অত্যাবশ্যক হিসেবে মতৈক্য হয়। এই প্রথমবারের মতো জনসংখ্যার গুণগত দিক তথা অধিকারের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, জেন্ডার সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার পরিকল্পনার মতো বিষয়গুলো অধিকতর গুরুত্ব পায়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৭৯টি দেশ থেকে ১১ হাজার প্রতিনিধি অংশ নেন।

তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা ও টেকসই উন্নয়ন

২৫ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন এবং বিগত দিনের প্রতিশ্রুতিগুলো ঘিরে ২০১৯ সালের ১২-১৪ নভেম্বর কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত হয় আইসিপিডি সম্মেলন। ওই সম্মেলনে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে একজন একাডেমিশিয়ান হিসেবে আমার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ ঘটেছিল। নাইরোবিতে তখন জাতিসংঘভুক্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার, নাগরিক সমাজ, বেসরকারি সংস্থা, নারী ও যুবা নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে যোগ দেন।

আরও পড়ুন

২৫ বছরে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে নানা অর্জনের পাশাপাশি বিদ্যমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে বিবেচনায় রেখে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে পুনঃপ্রতিশ্রুতি প্রদানে গুরুত্ব দেওয়া হয় সম্মেলেন। সেখানে ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি প্রদানেরও সুযোগ রাখা হয়েছিল। আমি বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নির্মূলের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দিই।

সম্মেলনের শেষ দিনে তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রাকে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনে অ্যাজেন্ডাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। এ তিন প্রতিশ্রুতি হলো পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা শূন্যতে নিয়ে আসা, শূন্য মাতৃ মৃত্যুহার এবং যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন এবং ক্ষতিকারক চর্চা নির্মূল। এসব প্রতিশ্রুতি সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরস্পর সম্পর্কিত।

বর্তমান পরিস্থিতি

নাইরোবি সম্মেলনের প্রায় তিন বছর হয়ে গেল। এর মধ্যেই সারা বিশ্ব করোনা মহামারির অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। নাইরোবি সম্মেলনের প্রথম প্রতিশ্রুতি হলো পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যতে নিয়ে আসা। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছরের বিবাহিত নারীদের মধ্যে যাঁরা আর কোনো সন্তান চান না বা কমপক্ষে দুই বছর পর পরবর্তী সন্তান চান কিন্তু বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করেন না, তার শতকরা হারই হলো অপূর্ণ চাহিদা।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৭-২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, অপূর্ণ চাহিদা হলো ১২ শতাংশ। যদিও সরকারের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) লক্ষ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যে অপূর্ণ চাহিদা ৯ শতাংশে পৌঁছানোর কথা। বিডিএইচএসের তথ্যে দেখা যায়, পরিবার পরিকল্পনার এ অপূর্ণ চাহিদা সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে ১৮ শতাংশ, সিলেট ও বরিশালে ১৪ শতাংশ এবং ঢাকা বিভাগে ১২ শতাংশ।

আরও পড়ুন

অপূর্ণ চাহিদার দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো স্পেসিং অর্থাৎ সন্তান ধারণে সময়ের ব্যবধান। আরেকটি হলো লিমিটিং অর্থাৎ সন্তান ধারণ সীমার মধ্যে রাখা। লিমিটিংয়ের ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা ৬.৬ শতাংশ আর স্পেসিংয়ের ক্ষেত্রে ৫.৪ শতাংশ। দুটো মিলে দেশে অপূর্ণ চাহিদা হলো ১২ শতাংশ।

পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদার হার দুই পর্যায়ের বয়সে বেশি দেখা যায়। ১৫-১৯ বছরের বিবাহিত নারীদের মধ্যে অপূর্ণ চাহিদা হলো ১৫.৫ শতাংশ। আর ২০-২৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৫.৭ শতাংশ। ২০১১ থেকে ২০১৮ সালে অপূর্ণ চাহিদার হার কমেছে মাত্র ১.৫ শতাংশ। গ্রামে অপূর্ণ চাহিদার হার শহর থেকে প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। গ্রাম-শহর, শিক্ষা, গৃহস্থালি সম্পদ, প্রশাসনিক বিভাগ, বিবাহের বয়স, পছন্দসই সন্তান নেওয়া, জন্মনিরোধের ব্যবহারের হারের সঙ্গে অপূর্ণ চাহিদার সম্পর্ক রয়েছে।

প্রতীকী ছবি

দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি হলো ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্য মাতৃমৃত্যু হারে পৌঁছানো। বর্তমানে এ হার এখনো অনেক বেশি। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যসেবা জরিপ (বিএমএমএস) অনুযায়ী, প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ১৯৬ জন মা মারা যান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য (এসভিআরএস) অনুযায়ী যা ১৬৩। যদিও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২২-২৫ অনুযায়ী এটার লক্ষ্যমাত্রা ১০০। আর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সেটা ৭০–এ পৌঁছাতে হবে বাংলাদেশকে।

বিএমএমএসের তথ্য অনুযায়ী, মাতৃমৃত্যু হার বেশি গ্রামে (২১৬.৬৬)। রাজশাহী (২৭৭.০৮), রংপুর (২২২.৭৩), বরিশাল (২১৬.৪৯) ও সিলেট (২১৩.৮৮) বিভাগে এ হার তূলনামূলক বেশি। মাতৃমৃত্যু হারে ভিন্নতা লক্ষ করা যায় বয়স, শিক্ষা ও গৃহস্থালি সম্পদের সূচক অনুযায়ী। বাংলাদেশে রক্তক্ষরণ ও একলাম্পসিয়ার কারণে ৫৫ শতাংশ মা মারা যান অথচ এটি প্রতিরোধযোগ্য। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এ দুটি কারণে মাতৃমৃত্যু হার অপরিবর্তিত রয়েছে।

অথচ এসব জটিলতা চিকিৎসায় অগ্রগতি যথেষ্ট হয়নি। লক্ষণীয় যে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও মাতৃমৃত্যু স্থিতাবস্থায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বলতে হয়, মাতৃস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

তৃতীয় প্রতিশ্রুতি হলো ২০৩০ সালের মধ্যে যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতনকে শূন্যতে নিয়ে আসা এবং ক্ষতিকারক চর্চা নির্মূল (যেমন বাল্যবিবাহ)। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ নারীর প্রতি সহিংসতা শীর্ষক জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৬৫.১ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন।

আর ২০.৫ শতাংশ দৈহিক আর ১৩.১ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। জরিপ চলাকালে গত ১২ মাসে বয়সভিত্তিক সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২০-২৪ বয়সী বিবাহিত নারীরা। সবচেয়ে বেশি শারীরিক নির্যাতন রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে। আর যৌন সহিংসতা রংপুর, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগে। শারীরিক ও যৌন উভয় সহিংসতাই শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি।

জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার মতো বাল্যবিবাহের হারও বাংলাদেশে অনেক বেশি। বিডিএইচএসের তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের অর্ধেকের বেশির বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের আগেই। যার বেশির ভাগই হচ্ছে গ্রামে (৬০.৭ শতাংশ)। রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগে এ হার তুলনামূলক বেশি। গ্রামে, দরিদ্র পরিবারে, শিক্ষা নেই এমন পরিবারে এ হার বেশি লক্ষ করা গেছে। আর ১৫ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় প্রায় ১৯.৩ শতাংশ নারীর।

বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-৩০ অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সের কন্যাশিশুর বিবাহ নির্মূল করা এবং ১৮ বছরের কম বয়সের কন্যাশিশুর বিবাহ এক–তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার কথা। কিন্তু তার কোনোটিই এখনো সম্ভব হয়নি।

কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সের কন্যাশিশুর বিবাহ নির্মূল করার কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে বাল্যবিবাহ শূন্যতে নামিয়ে আনার কথা। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের সময়সীমা ২০৩০ সাল। আবার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০২২-২৫) বাল্যবিবাহ ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা নির্মূলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অনুপস্থিত। সে ক্ষেত্রে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশের অর্জন সম্ভব হবে না। কারণ, বাল্যবিবাহ নিরোধ করা ছাড়া এসডিজির অর্ধেক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

২০৩০ সালের মধ্যে তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা মহামারির কারণে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার, মাতৃস্বাস্থ্য ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ও বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা স্পষ্টভাবে জানার জন্য জাতীয় গবেষণা প্রয়োজন। তবে বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে এটি প্রতীয়মান যে মহামারির প্রাদুর্ভাবের সময়ে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বাধার সম্মুখীন হয়েছে।

দেশব্যাপী লকডাউন বা বিধিনিষেধ আরোপ, করোনা সংক্রমণে প্রাথমিক পর্যায়ে ভীতি, পর্যাপ্ত জনবল সংকট এবং সেবা প্রদানকারী ও সেবা গ্রহণকারীদের মধ্যে উদ্ভূত বিরূপ পরিস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এ অবস্থায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সেবা ব্যাহত হয়েছে, প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা নিশ্চিত করা ছিল বিশেষ চ্যালেঞ্জ।

অতি সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২১ সালে বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থী ছিল প্রায় পাঁচ লাখ, যা মোট শিক্ষার্থীর ৭.২৩ শতাংশ। এসব শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ ঘটেছে ৯.৮৬ শতাংশ) আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে ১৬.১৫ শতাংশ। এ চিত্র পাওয়া গেছে মোট ১৯ হাজার ৪১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ১১ হাজার ৬৭৯টি থেকে।

করণীয়

তিন শূন্য প্রতিশ্রুতি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। সব কটি প্রতিশ্রুতির সংযোজনে চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সংশোধন হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

জাতীয় জনসংখ্যা নীতি, স্বাস্থ্যনীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, বাল্যবিবাহ নিরোধকল্পে জাতীয় কর্মপরিকল্পনাসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নীতি-পরিকল্পনা হালনাগাদ করতে হবে, যেখানে টেকসই উন্নয়ন হবে মূল উপজীব্য। প্রথম শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বা পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা পূরণে পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম অধিকতর শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে অঞ্চলভিত্তিক যেখানে সফলতা কম, সেখানে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।

যেমন চর-হাওর ও দুর্গম অঞ্চলে সেবা জোরদারের পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহিত করা, দম্পতি ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য, কিশোর–কিশোরীর অনুকূলে স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা, প্রশিক্ষিত জনবল ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিবার পরিকল্পনায় চাকরিতে রাখা, নিয়মিত তদারকি কার্যক্রম, পর্যাপ্ত বাজেট জোগান, স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয় করা, সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব ত্বরান্বিত করা।

মাতৃমৃত্যু হার কমাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দিকে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। দ্বিতীয় শূন্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে মাতৃত্বকালীন জটিলতা সহজেই চিহ্নিত করা ও দ্রুত চিকিৎসা প্রদান জরুরি। রক্তক্ষরণ বন্ধ ও একলাম্পসিয়া চিকিৎসায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সেবাদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চেয়ে বিদ্যমান অতি উচ্চ সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম) প্রসবের হার কীভাবে কমিয়ে আনা যায় ও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে মনোযোগ দিতে হবে।

তৃতীয় শূন্য প্রতিশ্রুতি-জেন্ডারভিত্তিক বা নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে দরকার সামাজিক গণসচেতনতা, নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় সেবা খুঁজে বের করা ও বহুমুখী খাতভিত্তিক পরিকল্পনা করে অগ্রসর হওয়া দরকার। একই সঙ্গে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রমও জোরদার করা দরকার।

দরিদ্র পরিবারে আর্থিক সহযোগিতা, মেয়েদের উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ও কাজের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি, জন্মনিবন্ধন ও বিয়ের নিবন্ধন কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারক করা, বাল্যবিবাহের ফলে বহুবিধ ঋণাত্মক প্রভাব যেমন সামাজিক, অর্থনৈতিক, জনমিতিক, স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে বিশেষ প্রচারাভিযান ও পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সামাজিক শ্রেয়বোধে পরিবর্তন আনা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটানোও দরকার।

পরিশেষে বলব, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আইসিপিডির কর্মসূচি ও প্রতিশ্রুতি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জাতীয় নীতি ও পরিকল্পনায় জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ইস্যুগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা দরকার। উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার তদারকি ও মূল্যায়নে গুণগত উপাত্তের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর উন্নয়নের ভিত্তিমূলে থাকতে হবে অধিকার, পছন্দ ও সমতা।

লেখক: অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল: [email protected]