দুই শিশুর মৃত্যুতে আইনগত দায় কার?

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি ঢাকার একটি বাসায় তেলাপোকা মারার স্প্রের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, পোকামাকড় নিধনে ‘ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড’ নামের একটি বালাইনাশক (পেস্ট কন্ট্রোল) প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বাসায় ডেকে আনেন ওই দুই শিশুর বাবা-মা। কীটনাশক স্প্রে করার পর কর্মীরা বলে যান, তিন ঘণ্টা যেন কেউ বাসায় না ঢোকেন। পরিবারটি বাইরে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। দম্পতির ছোট সন্তান শাহিল মোবারত জায়ান (৯) বাসাতেই মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর শাহিলের বড় ভাই শায়েন মোবারত জাহিনেরও (১৫) মৃত্যু হয়। তাদের ছোট বোনকেও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। পুলিশ ও চিকিৎসকেরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, শরীরে ‘টক্সিক কেমিক্যালের’ প্রভাবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ‘দায়িত্বে অবহেলাজনিত’ মৃত্যুর অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ‘ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড’–এর একজন কর্মী যিনি ওই বাসায় কীটনাশক স্প্রে করার দায়িত্বে ছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। সে সময় জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে একজন মারা গিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের ধারণা, সেটিও কীটনাশকের বিষক্রিয়ার ফলেই ঘটেছিল।

কৃষিক্ষেত্রের বাইরে বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে পোকামাকড় নিধনের জন্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত ‘পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রোভাইডার’ বা বালাইনাশক সেবা সরবরাহকারীদের কার্যক্রম দিন দিন বাড়ছে। ফলে জনবহুল আবাসিক এলাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বালাইনাশকের ব্যবহার করার ঝুঁকি এবং এ–সংক্রান্ত স্বাস্থ্যনিরাপত্তার বিষয়গুলো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা বেসরকারি পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের আইনি কর্তৃত্ব, নিবন্ধন, পেশাগত মান নিয়ন্ত্রণ এবং দায়িত্বে অবহেলায় অপরাধ ও শাস্তির বিধান নির্ধারণে বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনি কাঠামো নিয়ে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।

প্রচলিতভাবে এ ধরনের ঘটনায় ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪ক ধারায় অভিযোগ আনা হয় যেখানে অবহেলামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে কারও মৃত্যু ঘটালে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। দণ্ডবিধির ২৮৪ ধারাও এখানে প্রযোজ্য হতে পারে, যেখানে শাস্তি ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। কিন্তু দণ্ডবিধির এসব অবহেলাজনিত মৃত্যু বা ক্ষতির বিধানটি দেড় শ বছরের অধিক পুরোনো এবং সাধারণ একটি বিধান, যা সব ধরনের অবহেলামূলক কাজকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু বাণিজ্যিক পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টি একটি আধুনিক ও জটিল। এগুলো বিচার-বিবেচনা করার জন্য বিশেষায়িত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, কারিগরি নির্দেশনা, আইনগত ও নৈতিক মানদণ্ড এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের যুক্ততার প্রয়োজন আছে। দণ্ডবিধির শুধু শাস্তিমূলক বিধান দিয়ে এ ধরনের সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব কি না, তা একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।

বাবার সঙ্গে দুই ভাই শাহির মোবারত জায়ান ও শায়ান মোবারত জাহিন
ছবি: সংগৃহীত

বাণিজ্যিক পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের কর্মকাণ্ডের জনস্বাস্থ্যঝুঁকির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা সদস্যরাষ্ট্রগুলোর জন্য ২০১৫ সালে ‘পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের লাইসেন্সিং–বিষয়ক নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছে। এই নীতিমালায় বাণিজ্যিক পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের লাইসেন্সিং বা নিবন্ধন, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা, পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি, পেশাগত মান নির্ধারণ এবং এই সংক্রান্ত দায়িত্বে অবহেলার শাস্তি নির্ধারণ বিষয়ে বিস্তারিত গাইডলাইন প্রদান করেছে।

১৯৭২ সাল হতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তার দেশীয় আইনি কাঠামোয় এই আন্তর্জাতিক গাইডলাইনের কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে, তা পর্যালোচনা করা জরুরি।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে বালাইনাশক আমদানি, উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, বিক্রয়, বিতরণ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ‘বালাইনাশক (পেস্টিসাইডস) আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যেটি ১৯৭১ সালের পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্সকে প্রতিস্থাপিত করেছে। এই আইনের ধারা ৪ অনুসারে নিবন্ধনহীন সব বালাইনাশক বা পেস্টিসাইডস আমদানি, উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, মোড়কজাতকরণ ও পুনঃমোড়কজাতকরণ, বিক্রয় অথবা বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাব ও মজুত অথবা বিজ্ঞাপন প্রচারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের বিষয়ে শুধু এটুকু বলা আছে যে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক কর্তৃক ইস্যুকৃত লাইসেন্স ছাড়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি পরিচালনা এবং বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। কিন্তু ২০১৮ সালে এই আইন প্রণীত হলেও এখন পর্যন্ত এটির কোনো রুলস বা বিধি প্রণয়ন করা হয়নি।

তবে রহিত হওয়া ১৯৭১ সালের পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্সের আওতায় ১৯৮৫ সালে একটি পেস্টিসাইড রুলস প্রণয়ন করা হয়েছিল, যেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটরদের একটি ফরম (ফরম-১০) পূরণ ও ৫০০ টাকা লাইসেন্সিং ফি প্রদানের মাধ্যমে লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছিল। এই বিধির ৫৩ নম্বর অনুচ্ছেদে পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটর কর্তৃক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পেস্টিসাইডস স্প্রে করার সময় সম্ভাব্য বিষক্রিয়া প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফার্স্ট এইড সরঞ্জাম, প্রতিষেধক, ইনজেকশন ও ওষুধ মজুত রাখার কথা বলা হয়েছে। একই বিধির ৫৪ নম্বর অনুচ্ছেদে এই কাজে নিয়োজিত কর্মীদের নিরাপত্তা সতর্কতা এবং সরবরাহকৃত নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ আছে।

দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত ও বিচার শুরু হবে। তবে পেস্ট কন্ট্রোলার অপারেটরদের দায় নিরূপণে কিছু আইনগত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান জরুরি। এগুলো হলো:

১. ‘ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের পেস্টিসাইডস আইনের অধীনে ‘বাণিজ্যিক পেস্ট কন্ট্রোল অপারেটর’ হিসেবে নিবন্ধিত কি না?

২. পোকামাকড় মারতে সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড নামের ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়, যা থেকে ফসফিন গ্যাস নির্গত হয়। এই গ্যাস মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি প্রাণঘাতী হতে পারে। ওই বাসায় তেলাপোকা নিধনের জন্য কোন ধরনের পেস্টিসাইডস ব্যবহার করা হয়েছে? সেটি নিবন্ধিত কি না?

৩. পেস্টিসাইডসটি নিবন্ধিত হলেও সেটি আবাসিক এলাকায় বাসাবাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী ছিল কি না?

৪. যদি আগের তিনটি শর্তই পালিত হয়ে থাকে, দেখতে হবে যিনি বা যাঁরা এটি স্প্রে করেছেন, তিনি বা তাঁরা এই বিষাক্ত বস্তুর ব্যবহারবিধি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে ইতিমধ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কি না?

৫. ব্যবহৃত পেস্টিসাইডসের পরিমাণ ও মাত্রা কক্ষের আয়তন ও প্রয়োজনের অনুপাতে ঠিক ছিল কি না?

৬. পেস্ট কন্ট্রোলার অপারেটর কর্তৃক বাসার বাসিন্দাদের এই কেমিক্যাল ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি, প্রাণঘাতী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও পেস্টিসাইডস প্রদান পরবর্তী নিরাপত্তা সতর্কতা বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য ও আগাম সাবধানতার কথা বলা হয়েছিল কি না?

৭. ভুক্তভোগীদের পরিবার কর্তৃক কোনো অবহেলা বা অসতর্কতা রয়েছে কি না অর্থাৎ তারা পেস্ট কন্ট্রোলার অপারেটরদের নির্দেশনা অমান্য করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি না?

৮. এ ঘটনায় শুধু প্রতিষ্ঠানটির কর্মীকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক দায় প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা কর্তব্য।

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক পেস্ট কন্ট্রোল অপারেশন বিষয়ে স্বতন্ত্র ও বিশদ নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দুটি শিশুর এমন করুণ মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা এবং আইনগত সীমাবদ্ধতা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর বিপদের কারণ হতে পারে।

সাঈদ আহসান খালিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক