প্যারেন্টাল শেড: ভেক্টর প্লিন্থের নিউ-মডার্ন স্থাপত্যশিল্পে অপেক্ষার আড়ালে মায়া ও মমতার স্থাপত্য
সকালবেলা চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের প্রাঙ্গণে দেখা যায় একটি পরিচিত দৃশ্য। সন্তান স্কুলে প্রবেশ করছে আর অভিভাবকেরা গেটের বাইরে অপেক্ষায়। সেই অপেক্ষার মুহূর্তগুলোকে ঘিরেই স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান ‘ভেক্টর প্লিন্থ’ নির্মাণ করেছে এক অনন্য স্থাপত্য ‘প্যারেন্টাল শেড’। যা কেবল বসার স্থান নয়, বরং এক নিঃশব্দ সংযোগের প্রতীক।
প্রকল্পটির ধারণা এসেছে এক মানবিক মুহূর্ত থেকে। একজন মা তাঁর সন্তানকে কোলে নিয়ে আছেন। সেই দৃশ্যকল্পকে বিমূর্ত করে স্থপতিরা রূপ দিয়েছেন একটি পেন্টাগোনাল (পাঁচকোনা) কাঠামোতে, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে জ্যামিতিক হলেও অভ্যন্তরে এক আশ্রয়ের অনুভব জাগায়।
ভেক্টর প্লিন্থের ডিজাইন টিমের মুহাম্মদ জাবেদ ইকবাল রূপম ও মোহাম্মদ ফয়সাল সাবরী এই প্রকল্পে স্থাপত্যের মাধ্যমে একটি সম্পর্কের গল্প বলতে চেয়েছেন। মা যখন তাঁর নবজাতক সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাখেন, সেই চিরন্তন দৃশ্যই হয়ে ওঠে এই স্থাপনার রূপক।
স্থাপনাটির গঠন একটি বিমূর্ত, পেন্টাগোনাল জ্যামিতিক রূপ, যা প্রতীকী অর্থে তুলে ধরে অভিভাবকের আশ্রয়, কোলে টেনে নেওয়া এবং ভালোবাসার নিরাপত্তা। প্রথমে একটি মা ও শিশুর প্রতিচ্ছবি থেকে রাফ স্কেচ তৈরি হয়, পরে ৫-৬টি রিফাইনড স্কেচের পর চূড়ান্ত রূপ পায় কাঠামোটি। স্থপতিরা এটিকে শুধু শেল্টার হিসেবে নয়, একটি আবেগীয় অভিজ্ঞতা নির্মাণের ক্ষেত্র হিসেবে ভাবেন।
প্রায় ১ হাজার ১০০ বর্গফুটের এই স্থাপনাটি আরসিসি ফ্রেম স্ট্রাকচারে নির্মিত, যেখানে একটিমাত্র এক্সটার্নাল ফ্রেমিং সিস্টেম ব্যবহার করে পুরো ছাদ ও দেয়াল ধারণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরে কোনো কলাম নেই, যার ফলে চলাচলে কোনো বাধা পড়ে না। পুরো স্পেসটি একটানা ও প্রবহমান—একটি মুক্ত অভ্যন্তর। এই গঠনশৈলী ব্যবহারকারীদের মধ্যে অবাধ সংযোগ, দৃষ্টিনন্দন ও আলোপ্রবাহ নিশ্চিত করে।
একটি স্থাপনার ভেতর-বাইরের মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলার জন্য স্থপতিরা ব্যবহার করেছেন ফুল-হাইট ইনক্লাইনড কার্টেন গ্লাস ওয়াল। এই কাচের দেয়ালগুলো কেবল বাইরের প্রকৃতিকে ভেতরে নিয়ে আসে না, বরং দিনের আলোকে ছায়ায় রূপান্তর করে একটি নরম, শান্ত অভ্যন্তর তৈরি করে। গ্লাসের কৌণিকতা সূর্যালোককে সরাসরি না এনে ভেঙে আনে, ফলে তাপ হ্রাস পায় এবং অভ্যন্তরে একটি আরামদায়ক পরিবেশ বজায় থাকে।
ভবনের ছাদে ব্যবহৃত হয়েছে সিরামিক রুফ টাইলস, যা তাপকে প্রতিফলিত করে ও গরমের পরিমাণ কমায়। এই পদার্থটি স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য এবং রক্ষণাবেক্ষণেও সাশ্রয়ী, যা ভবিষ্যতের টেকসই ব্যবহারের দিক থেকেও কার্যকর। এতে নির্মাণ খরচ কমার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে ভালো পারফরম্যান্স নিশ্চিত হয়।
ভেতরে বসার বিন্যাস এমনভাবে পরিকল্পিত, যাতে ব্যবহারকারীদের চলাচল নির্বিঘ্ন হয়। ছোট ছোট গ্রুপে বসার সুযোগ, উন্মুক্ততা ও আলোছায়ার খেলা—সব মিলিয়ে এখানে অপেক্ষার সময়টুকু হয়ে ওঠে এক শান্ত অভিজ্ঞতা। প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত এই পরিবেশ যেন স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে সম্পর্কের ভাষা বলে।
গ্লাসের স্বচ্ছতা ও স্পেসিংয়ের কারণে ভেতরের আলোর ছায়া, বাইরের গাছের পাতা নড়ার শব্দ কিংবা হাওয়ার হালকা পরশ—সবকিছুই স্পেসটির মধ্যে যেন প্রাণের সঞ্চার করে। এটি স্থাপত্যের একটি স্পর্শযোগ্য মানবিক অনুভূতি, যেখানে কেবল বসা নয়, অনুভব করাও সম্ভব।
‘প্যারেন্টাল শেড’ শুধু একটি ছায়ার নিচে বসার জায়গা নয়। এটি অভিভাবকত্ব, ভালোবাসা, প্রতীক্ষা এবং আত্মিক সংযোগের একটি স্পেসিয়াল রূপান্তর। এখানে স্থাপত্য কথা বলে নিঃশব্দে কিন্তু গভীরভাবে। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে সন্তানদের জন্য অপেক্ষার সময় আর একঘেয়ে নয়, বরং হয়ে ওঠে এক নীরব সম্পর্কের উদ্যাপন।
ভেক্টর প্লিন্থের এই কাজ নিছক একটি কাঠামো নয়, বরং স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে ভালোবাসাকে দৃশ্যমান করার এক সফল প্রয়াস।