আগুনে মৃত্যু খলিলুরের, সংকটাপন্ন চিকিৎসক লতা

চিকিৎসক লতা আক্তারের শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে। তিনি এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীনছবি: প্রথম আলো

কক্ষে বসে পড়ছিলেন চিকিৎসক লতা আক্তার (২৭)। অন্য কক্ষে মা দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। হুট করেই লতার সাবেক স্বামী কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। এরপর তিনি লতাকে জাপটে ধরে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। নিজের গায়েও আগুন ধরান। মুমূর্ষু অবস্থায় লতা নিজেই স্বজনদের এসব জানিয়েছেন বলে জানান তাঁর ফুফাতো ভাই সজীব আহমেদ। তিনি জানান, প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙে দগ্ধ অবস্থায় দুজনকে দেখতে পান।

আজ মঙ্গলবার সজীব আহমেদের সঙ্গে কথা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চতুর্থ তলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে দাঁড়িয়ে। আইসিইউর ১৫ নম্বর শয্যায় লতা চিকিৎসাধীন। আইসিইউর পাশে থাকা অপেক্ষাকক্ষে স্বজনেরা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা নিয়ে দুই দিন ধরে পালা করে অবস্থান করছেন। ওই সময় স্বজনদের মধ্যে ছিলেন লতার ফুফাতো ভাই সজীব আহমেদ।

চিকিৎসকদের ভাষ্য, লতার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তাঁর শরীরের ৮০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে।

গত রোববার বেলা পৌনে একটার দিকে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মরজাল ইউনিয়নের ব্রাহ্মণের টেক গ্রামে গায়ে আগুন লাগানোর এ ঘটনা ঘটে। লতার সাবেক স্বামী মো. খলিলুর রহমান (৩৫) গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।

লতার পরিবার ও পুলিশের ভাষ্য, খলিলুর রহমান পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। প্রেম ও বিয়ের সময় পেশার কথা গোপন করেন খলিলুর। বিয়ের পর তা জানতে পেরে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান লতা। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে লতার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন এবং নিজের গায়েও আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন খলিলুর।

গ্রামের বাড়িতে লতা ও তাঁর মা বাস করেন। তাঁর বাবা মারা গেছেন। বড় দুই ভাই–বোন ইতালিপ্রবাসী। রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে লতা নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত। মারা যাওয়া খলিলুর রহমানের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকায়।

‘কানাডার নাগরিক পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেন খলিলুর’

সজীব আহমেদ জানান, লতার প্রেমের সম্পর্কের বিষয়ে পরিবারের কেউ কিছুই জানতেন না। দুই বছর আগে তাঁরা গোপনে বিয়ে করেন। বিয়ের পর খলিলুরের প্রতারণা ধরা পড়ার পর পরিবারকে জানান লতা। ছয় মাস আগে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।

সজীব বলেন, লতা তাঁদের জানিয়েছিলেন যে এক বন্ধুর মাধ্যমে ঢাকায় খলিলুরের সঙ্গে পরিচয় হয়। খলিলুর বেশ লম্বা ও সুদর্শন ছিলেন। নিজেকে কানাডার নাগরিক এবং তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। বিয়ের পর লতা জানতে পারেন যে খলিলুর তথ্য গোপন করে প্রতারণা করে বিয়ে করেছেন। তিনি আসলে গাড়িচালক। এরপরই বিচ্ছেদ চান লতা। ছয় মাস আগে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। বিচ্ছেদ নিয়ে খুব ক্ষুব্ধ ছিলেন খলিলুর। তিনি দেনদরবার করতে ঘটনার দিনের আগেও একবার রায়পুরায় এসেছিলেন।

ঘটনার দিনের কথা উল্লেখ করে সজীব বলেন, একটা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে খলিলুর এসেছিলেন। তিনি পেট্রল নিয়ে পেছনের গেট দিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। লতা তাঁদের জানিয়েছেন, খলিলুর কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তাঁকে জাপটে ধরে গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগান। পরে নিজের গায়েও লাগান। তাঁদের চিৎকার শুনে লতার মা ছুটে আসেন। তিনি দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ পান। ওই সময় তাঁর চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে এসে কোদাল দিয়ে দরজা ভেঙে দুজনকে আগুনলাগা অবস্থায় দেখতে পান। আগুন নিভিয়ে প্রথমে তাঁদের স্থানীয় হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় আনা হয়। এ ঘটনায় রায়পুরা থানায় পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

এদিকে ঘটনা নিয়ে ভিন্ন একটি ভাষ্য পুলিশকে দিয়েছেন খলিলুর রহমানের বড় ভাই মুদিদোকানি মো. জলিল। মুঠোফোনে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, খলিলুর হাসপাতালে তাঁদের বলেছেন, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে গায়ে আগুন লাগান। সে কথাই পুলিশকে জানিয়েছেন তিনি।

মো. জলিল জানান, তাঁরা গাজীপুরের কাপাসিয়ায় থাকেন। তাঁর বাবা কৃষক ছিলেন। তাঁদের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন খলিলুর। খলিলুর স্কুলের গন্ডি পেরোননি। সামান্য পড়াশোনা করেছেন। খলিলুর ঢাকায় কখনো ব্যক্তিগত গাড়ি, কখনো বাস চালাতেন। লতার সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের প্রেম, বিয়ে ও বিচ্ছেদের কিছুই তাঁরা জানতেন না। পেশার কথা গোপন করে তাঁর ভাই বিয়ে করেছিলেন কি না, সেটা তাঁর জানা নেই। গতকাল কাপাসিয়ায় খলিলুরকে দাফন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

রায়পুরা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সাফায়েত হোসেন আজ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, খলিলুরের ভাই বলেছেন, ওই দিন কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে দুজনই যাঁর যাঁর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। লতার পরিবার থেকে জানা গেছে, খলিলুর লতার গায়ে আগুন লাগিয়ে পরে নিজের গায়ে আগুন লাগান। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। সেই মামলা ধরে পুলিশ তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা বের করবে।

লতার অবস্থা সংকটাপন্ন

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে কর্মরত মেডিকেল কর্মকর্তা জ্যোতি রানি বিশ্বাস আইসিইউ থেকে বের হওয়ামাত্র বিভিন্ন রোগীর স্বজনেরা তাঁকে ঘিরে ধরছিলেন। উৎকণ্ঠা নিয়ে তাঁরা রোগীর অবস্থা জানতে চাইছিলেন। ওই সময় লতার অবস্থা জানতে চাইলে জ্যোতি রানি বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, লতার অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁকে ভেন্টিলেশনে (কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা) রাখা হয়েছে।

ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মো. তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, লতা চিকিৎসক হওয়ায় তিনি নিজের অবস্থা বুঝতে পারছিলেন। রোববার হাসপাতালে আনার পর তিনি বলছিলেন, ‘আমাকে ভেন্টিলেশনে দিন।’ তরিকুল ইসলাম জানান, লতার অবস্থা খুব সংকটাপন্ন। আজ তাঁর কিডনি অনেকখানি কার্যকারিতা হারিয়েছে।

আরও পড়ুন